সৌম্য চৌধুরি
সে না হয় বেহালা কিংবা বরানগরেই থাকলেন। নিজেকে একটু সাদাসিধে সময় দিন। দিনমানের চক্করবাজি কম তো করতে হয় না। বেড়াতে যাবার কথা উঠলে, ছাব্বিশ বছরের পোষা কাকাতুয়ার লেভেলে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজেকে সাধক কিংবা বাবাজি মনে হয়। টাকা-পয়সা, ট্রেন বা প্লেনের তিকিট, মায়ের ওষুধ, বাবার সিদ্ধ চাল- মাল মেটেরিয়ালের যা চব্য, তাতে ছন্দ লেখার ক্ষমতা থাকলে আর একটা আবোল তাবোল লিখে ফেলা বাঁ হাতের ময়লা। সে গুড়ে হিমালয়। সুতরাং ঘানিচক্কর ঘুরিয়ে যাওয়াই কম্পারেটিভলি সেফ। হপ্তায় দু’দিন বাজার, সকালে মেয়ের স্কুলবাস, দুটো হাতরুটির টিফিন, শাটলে অফিস, রাতে দু’পাত্তর মেরে কুমার শানুর দো দিল মিল রহে হ্যায় গাইতে গাইতে বউকে বড়গিন্নি বলে ডেকে মুখঝামটা খেয়ে অফিসের বসের বাচ্চাকে তেড়ে খিস্তি করে দেড় চামচ ঘুম।
তাই বলছিলুম নিজেকে একটু সাদাসিধে সময় দিন। দিনমানের চক্করবাজি কম তো করতে হয় না। ভোর ভোর উঠে পড়ুন। বাসই না হয় ধরলেন। রোদ অঠার আগেই নেমে পড়তে হবে আকাশবানী ভবনের সামনেটায়। এইবারে হালকা করে হাঁটতে হাঁটতে লাইফটাকে রিওয়াইন্ড করতে হবে। মনে আছে, দাদুর হাত ধরে মোহনবাগান-টালিগঞ্জ অগ্রগামী লিগের ম্যাচ? কাঠের গ্যালারি? উত্তেজিত দাদুর মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে খিস্তি দেওয়া। শিশিরের গোল। এগুলো ভাবুন। রামদেব ফামদেব ভাবতে হবে না, বয়েস চড়চড় করে কমবে। বিটনুন দিয়ে লম্বা ফালি করা শসার কথা, শালপাতায় ঘুগনি, পেতলের কলসি থেকে খুরিতে ঢেলে দেওয়া স্যাকারিনের চা-এর কথা, খেলা দেখে ফেরার পথে ঠান্ডা প্যাটিস, আহা সেই ময়দানি প্যাটিসের কথা ভাবুন না মশাই একবারটি।
এতক্ষণে আপনি একটুখানি এগিয়েছেন বাবুঘাটের দিকে। এইবারে ইস্টবেঙ্গল টেন্টে যাওয়ার রাস্তাটা ধরুন। বাঁদিকে। আহা, একফালি ফরেন যেন। রাস্তার দু’দিকে গাছ। কাঠের ওপর ডিপ সবুজ কালার, কাস্ট আয়রনের কলকা লাগানো বেঞ্চি, আহা! আহা! এই ফিলটা যখন পাচ্ছেন তখন ডানদিকে তাকালেই সেন্ট্রাল এক্সাইজের টেন্টটা দেখতে পাবেন। সোজা এন্টার।
এখানে কিন্তু কর্মযজ্ঞ চলছে। চৌকো ঘেরা জায়গাটা সেই ওয়ান্ডারল্যান্ড। যেখান থেকে হাতবদল হয় অমৃত। আপনি যখন উঠছেন তার আগেই নিউ মার্কেট থেকে বাজার করা হয়ে গিয়েছে। আলু, পেঁপে, বিনস, তিরিশ কিলো চিকেন, খাসির মাংস, মাটন লিভার ইত্যাদি। মুরগিগুলোর দিকে এক ঝলক তাকালেই বুঝবেন কি ফ্রেশ। কী খেয়ে বড় হয় কে জানে! এবার এগুলো কাটা-বাছা-ধোয়া হচ্ছে। তুমুল ব্যস্ততা। এক হাতে তিনিটে উনুন সামলাচ্ছে চিফ রাঁধুনি মারুতি শর্মা। ঝাড়খন্ডের লোক। যখন এসেছিল তখন অবশ্য বিহার ছিল। এ-সব জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো থাকবে অমৃত ডালা। চিকেন স্টু, মাটন স্টু, ভেজ স্টু, মাটন লিভার কারি- কষকষে খেতে, ঘুগনি। খেতে হবে পিস করা পাউরুটি দিয়ে। কড়কড়ে সেঁকা। একটু পোড়া পোড়া দাগ থাকবে। এটা নাকি লিভারের জন্য খারাপ। কাবাবেও থাকে। এই পোড়া কার্বন খেয়ে নাকি মুঘল সম্রাটদের সিরোসিস অফ লিভার হত। মাল খেয়ে নয়! মরুকগে!!
সকাল সকাল সবার আগে হয়ে যাবে চিকেন স্টু-টা। এরিয়ান্স ক্লাবে যাবে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যাবে। প্র্যাকটিস সেরে উঠেই খাবে মেহতাব-সঞ্জুরা।
একপ্লেট চিকেন স্টু খেয়ে নিন। সঙ্গে দু-পিস সেঁকা পাউরুটি। রইসপনা করার ইচ্ছে হলে একটু মাখন লাগিয়ে দিতে বলুন। সাদা প্লেটে দু-পিস চিকেন, একফালি গাজর, একফালি পেঁপে আর এক টুকরো আলু আছে। আর আছে ঝোলটা। ভাসছে মাখন। এক চামচ তুলুন। চোখটা বোজান। ঠোঁটদুটো চুমু খাওয়ার মতো ছুঁচলো করে সুউউউউপ করে টেনে নিন ঝোলটা। তারপর আহহ না বললে আপনি মানুষই না।
তাই বলছিলুম। নিজেকে একটু সাদাসিধে সময় দিন।
লেখা- অক্টোবর, ২০১২