‘কাবাব সম্পর্কে দু’মিনিট ভাষণ দাও ডিয়ার। ততক্ষনে কাবাব এসে যাবে।’ জিজো বলল। জিজো আমার নাতি, আমায় ডিয়ার বলে।দু’দিন আগে দুপুর হয় হয় সময়ে যখন কলকাতা স্টেশন থেকে লখনউ আসার গাড়ি ছাড়ল, জিজো বলেছিল, ‘পরশু আমাদের দুপুরের ডিম কাবাব, বিরিয়ানি আর জর্দা।’ লখনউ-এর তিন বিখ্যাত খাবার। ‘জর্দা?’ আঁতকে উঠেছিল আমার স্ত্রী মানে জিজোর ডার্লিং, ‘আরে জর্দা হল একরকমের পায়েস। আমাদের স্কুলের মানসী ম্যাম বলছেন।’- জিজো বলে।
যা হোক দিনের দিন রেস্তোরাঁয় হাজির আমরা পাঁচজন। আমরা তিনজন ছাড়া জিজোর বাবা, মা কৌশিক আর মুনিয়া। এটা সাধারণত আমাদের ঘোরার টিম। জিজোর কথা শুনে আমি কথা বলা পুতুলের মতো বলে উঠলাম, ‘লখনউ মানে আওধি কাবাব তাওয়াতে রান্না হয় আর মোগলাই কাবাবের জন্য তন্দুর লাগে। আবার পাঞ্জাবি কাবাব যেমন তন্দুরে গ্রিল করা হয়, এখানকার কাবাব তেমনি চুলাতে গ্রিল করা হয়।’
ততক্ষণে হই হই ক্রে ধোঁয়া ওঠা কাবাব দুটো পাত্রে এসে পড়েছে। শামি কাবাব আর পসিন্দা কাবাব। ‘দুটোর মধ্যে ফারাক কী?’ আমি হাঁ মুখ করে ক্রে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে বলি। মুনিয়া বলল, ‘ভেঙে মুখে দাও মূল পার্থক্যটা বুঝতে পারবে।’ হ্যাঁ বুঝি। শামি কাবাবে কিমা আর ছোলার ডাল, পসিন্দা কাবাবে থেঁতলানো মাংস। শামি কাবাব একটু মিষ্টি। একটু বলতেই মুনিয়া বলল, মশলার কথা বাদ দাও। একটাতে ডিম আছে আরেকটাতে টকদই।
‘তোমার পোস্টমর্টেম থাকবে? মন দিয়ে খেতে দাও।’ কৌশিকের অনুযোগ। কিন্তু এটা আমাদের বাবা মেয়ের অভ্যাস। বিশ্লেষণ চাই-ই। তাই বিরিয়ানি আসার আগেও দু’মিনিট বক্তব্য রাখলাম। পার্শি শব্দ ‘বিরিয়ান’ থেকে বিরিয়ানি এসেছে। যার অর্থ ‘রান্নার আগে ভাজা’। বিরিয়ানির মূল উপকরণ হল বাসমতী চাল, মাংস, দই, মশলা, ঘি, সেন্ট। এখানকার বিরিয়ানিকে বলে পাক্কি বিরিয়ানি, মানে পাকা অর্থাৎ রান্না করা। শুনতে অদ্ভুত লাগে, রান্না করা। আরে রান্না তো করতেই হবে না হলে বিরিয়ানি তৈরি হবে কীভাবে। আসলে ব্যাপারটা হল, চাল ও মাংস আলাদা আলাদা রান্না করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে সেঁকা বা ‘বেক’ করা। বিরিয়ানি এসে পড়ার পর কোনও কথা নেই। জর্দাও এল। গোবিন্দভোগ চাল, চিনি, ক্রিম, মাখন আছে বঝা গেল। ছত এলাচ, জাফরান, পেস্তা, কাজু, এলাচ গুঁড়ো, দারচিনি গুঁড়ো তো থাকেই। শুনেছি এক চিমটে নুন দেওয়া হয়। অসাধারণ উপাদেয় খাবার।
দুপুরে জব্বর খাওয়ার পর রাত্তিরে নমো নমো। কিন্তু রাতে যখন পাঁচজন আড্ডা দিতে জাঁকিয়ে বসেছি, জিজো আবার সাঁকো নেড়ে দিল। কাশ্মীর যাবার সময় আমি খুব ছোট ছিলাম, তুমি কাশ্মীরের কথা বল।
কাশ্মীরের কথা মানে কাশ্মীরি ‘ডিশ’-এর কথা। কাশ্মীরে মাংস বলতে হিল-মটন মানে পাহাড়ি ভেড়া। অপূর্ব স্বাদ। কাশ্মীরি লঙ্কায় ঝাল নেই, রঙ হয় লা-জবাব, রান্নায় জাফরান ব্যভার বেশি। তাছাড়া টমেটো আপেল থেকে শীতের সবজিও খুব খাওয়া হয়। সব মিলিয়ে স্বাদে গন্ধে জমজমাট। ‘ওখানে খেয়েছিলাম রোগণ জোশ আর ওয়াজওয়ান। এখনও মুখে লেগে আছে।’ আমার স্ত্রী বলেন। ‘বিস্তারে যাও ডার্লিং’- জিজো বলে। ‘মাংস, ঘি, টকদই, কেওড়ার জল, খোয়াক্ষীর, কাগজি বাদামের সঙ্গে হিং, লবঙ্গ, আদা, লঙ্কা, দারচিনি, চিনি, গরম মশলা, জাফরান, নুন।’ জিজোর ডার্লিং রেসিডেন্সি রোডের ‘মুঘল দরবার’ –এ খাওয়ার সময় লক ধরে নত করে নিয়েছিল। ‘ওয়াজওয়ান’ হচ্ছে চিকেন আর মাটনের মিক্সড প্রিপারেশন। শ্রীনগরে আরেকটা ‘প্রিপারেশন’ ভাল লেগেছিল। ‘মাটন ইয়াখনি’ মাংসের সঙ্গে দই বেসন গোলা। এখন ক্লাস ফাইভে পড়া জিজোর স্কুলের ছুটির ওপর আমাদের বাইরে যাওয়া নির্ভর করে। গত শীতে গিয়েছিলাম পাঞ্জাব। তার আগের শীতে ‘লং-ট্যুর’ গোয়া, পুনে, মুম্বই, গুজরাট। মাঝে অবশ্য হায়দ্রাবাদ, কেরল ঝটিকা সফর করে এসেছিলাম আমি আর মল্লিকা, আমার স্ত্রী। কৌশিক অফিস ট্যুরে অহরহ যায় জয়পুর, রাজস্থান। কৌশিককে শুনেই যেতে হয়, বলার সুযোগ তেমন একটা পায় না। তার পরের রাত্তিরে কম্বলের তলায় পা ডুবিয়ে বসে তাকে যখন মুনিয়া বলল, ‘রাজস্থানের খানা কাহিনি শোনাও।’ কৌশিক শুরু করে দিল, ‘আমি যা খাই তাই বলি।’ বেজড় কি রোটি, বেসনের ডাল, লাল মাংস। বেসন, আটা, ভুট্টা, বজরা, জোয়ার দিয়ে তৈরি বেজড় কি রোটি। তা গুঁড়ো করে তাতে দেশি ঘি। এর সঙ্গে বেসনের ডাল এত ‘টেস্টি’ যে কি বলব। হোটেলের বয়-কে ভজিয়ে ভেতরের এক রাঁধুনিকে রেসিপি নিয়ে মুনিয়াকে দিয়েছিলাম। বেসন আর দই সমান সমান মিশিয়ে ভাল করে ফেটাতে হবে। কড়াইতে ঘি দিয়ে গোটা লঙ্কা, জিরে, মৌরি ফোড়ন দিয়ে ফেটানো দই বেসন ঢেলে ভাল করে ফোটাতে হবে। পরিমাণমতো নুন, চিনি। এই ডালে ভাজা বড়ি আর মটরশুঁটি দেওয়া হয়।
‘বাঃ একশোয় একশো। এবার লাল মাংস’। মুনিয়া হাততালি দেয়। ‘যতটুকু বুঝেছি, খাসির মাংস আর দইয়ের প্রিপারেশন, মাংসের গায়ে লেগে থাকা পেয়াজের রঙ সোনালি। আর একটুও ঝোল নেই, গা মাখা মাখা।’
কৌশিক পরিক্ষায় পাস করার পর মল্লিকার ‘টার্ম’ এল। ‘কেরলে খেয়েছিলাম একটা ডিমের…’ বলতেই সকলে হই হই করে উঠল, ‘নাম বল।’
না বলতে পারাতে সঙ্গে সঙ্গে জ্যান্সি জোস-কে টেলিফোন করা হল।
ও তিরুবনন্তপুরমের মেয়ে। কলকাতায় থাকত। একসময় আমার সহকর্মী ছিল। খাবারের বিবরণ দিতে ও বাংলা করে বলল, ‘ডিমের মৌলি’। আমার স্পিকার অন করে রেসিপিটাও শুনলাম।
ফালি করা সেদ্ধ ডিম, কুচানো পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, রসুন, আদা, হলুদ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, লেবুর রস, ঘি, নুন আর অন্তত দেড় কাপ ঘন নারকেল দুধ। গরম ঘি-তে পেঁয়াজ লালচে করে ভেজে সব কুচানো আর গুঁড়ো মশলা দিয়ে হালকা ভাজা হলে তাতে নারকেলের দুধ ঢেলে ফোটাতে হবে। এবার ডিম, আলাদা ধনেপাতা আর লেবুর রস মিশিয়ে একটু ফুতিয়ে নামাতে হবে। ‘থ্যাঙ্ক ইউ জ্যান্সি’ বলে ফোন বন্ধ করার পর জিজো বলল, ‘ডার্লিং তুমি দশে এক। শিগগিরি হায়দ্রাবাদের কথা বল না হলে গাড্ডু।’
মল্লিকা ঠিকঠাক বলার আগে আমি মুখবন্ধটা করে দিলাম।
নিজামের রাজ্যে রান্নায় মোগলদের প্রভাব বেশি। পরে ফরাসিরা আসায় রান্নায় তাদেরও ছাপ আছে। ‘প্রিপারেশন’-এ বাদাম, পেস্তা, নারকেলের দুধ যেমন চলে তেমন ভেড়ার সঙ্গে বিনের রোস্টও এরা শখে বানায়।
মল্লিকার হায়দ্রাবাদে বিরিয়ানির থেকেও ভাল লেগেছিল নবাবি পোলাও। বাসমতী চাল, হাড় ছাড়া মাংস, টকদই, পাতিলেবুর প্রিপারেশন। সঙ্গে পেঁয়াজ, আদা-রসুন বাটা, গোলমরিচ, লবঙ্গ, এলাচ কুচানো, পেস্তা, আমণ্ড, কিশমিশ, জাফরানের গন্ধে মন উদাস হয়ে যায়। ‘চিকেন হায়দ্রাবাদী’ও দুর্দান্ত। অন্য বাঁধাগতের মশলার সঙ্গে পুদিনা পাতা, ধনেপাতা, টমেটো, কাঁচালঙ্কা দিয়ে মুরগি। মল্লিকা এমনভাবে বলল, যেন তখনই খাচ্ছে।
রাতের অধিবেশন এখানেই শেষ হল। কিন্তু বিছানায় শুয়ে আমার মন ঘুরতে লাগল পাঞ্জাব, গোয়া, পুনে, মুম্বই, গুজরাটের প্লেটে প্লেটে। সে সব কাহিনি এবার শোনাই। অমৃতসরে আমরা খেয়েছিলাম মাক্কি কি রোটি, শুখা গোস্ত আর কিশমিশ, পেস্তা, বাদাম, সর দিয়ে লস্যি। কলকাতায় যা সচরাচর পাই না। ভুট্টার ময়দায় নুন, লঙ্কার গুঁড়ো, মিশিয়ে গরম জল দিয়ে মেখে, বড় লেচি করে ভেজা ন্যাকড়ার ওপর রেখে হাতের তালু দিয়ে বেলা ‘মাক্কি কি রোটি’। এর সঙ্গে ‘সরসোঁ কা সাগ’ খাওয়াই বিধেয়, কিন্তু সকলেই প্রবল আমিষাশী তাই পছন্দ হল শুখা গোস্ত। শুধু খাওয়া নয় ধরাধরি করে রেসিপিটাও জেনে নেওয়া গেল। একটু ছোট ছোট টুকরোয় মাংস, ধনে, পেঁয়াজ, রসুন, মেথি, শুকনো লঙ্কা বাটা আর ফেটানো দই মাখিয়ে ফ্রিজে সারারাত রাখা থাকে। মাংস ভাপে সেদ্ধ করাই ঠিক নয়ত প্রেশার কুকারে আধঘণ্টাটাক রাখতেই হবে। পরে ডেকচিতে ঘি বা বাদাম তেলে গরম করে পুরো মাংস নাড়াচাড়া করে ভাজতে হবে। জল শুকিয়ে গেলে সবটা ভাজা ভাজা হবে। ঘি ভেসে উঠবে, ওটাই শুখা গোস্ত।
অতঃপর গোয়া, পুনে, মুম্বই, গুজরাট। মুম্বইয়ে অবশ্য খাওয়াদাওয়ায় কসমোপোলিটন চেহারা। গোয়ার রান্নায় প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মিশেল, পর্তুগিজরা সাড়ে চারশো বছর গোয়ায় ছিল। গোয়ানিজদের রান্নায় তাদের প্রভাব বেশি। পাশেই সমুদ্র অর্থাৎ সামুদ্রিক মাছ। আমরা ভালবেসে খেয়েছিলাম পমফ্রেট কারি। নারকেল কোরা, নারকেলের দুধ, আস্ত ধনে, মেথি, জিরে, রসুন, পেঁয়াজ, সর্ষে ইত্যাদির সঙ্গে তেঁতুল গোলা জল দিয়ে পমফ্রেট কারি। মুখে বললে হবে না। চোখে দেখতে হবে। পুনেতে খেয়েছিলাম কোলাপুরী মাটন। ধনে, তিল, পোস্ত, নারকেল, গরম মশলার সঙ্গে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাধারণ সামগ্রী দিয়ে রান্না মাংস। বেশ গাঢ় ঝোল। শুধু ভাত কিংবা টমেটো পালক ভাত দিয়ে মাখা আর খাওয়া।
এই যে দিস্তে দিস্তে আমিষ খাওয়ার বিবরণ দিলাম। শ্রীকৃষ্ণ আর মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থান গুজরাটে গিয়ে আমরা প্রবল নিরামিষাশী হলাম। সাদা ভাত দিয়ে খেলাম বাঁধাকফির সম্ভরা, খাটুমিঠু পরওয়ালা মানে পটল। তার সঙ্গে তিল নারকেল শুকনো লঙ্কা দিয়ে কারিপাতার চাটনি। বাঁধাকফি, গাজর, লেবুর রস, হিং, চিনির সঙ্গে অন্যান্য সর্বঘটের চালু মশলায় তৈরি সম্ভরা। আমচুর, গুড়, টমেটো, কাঁচালঙ্কা, হিং ইত্যাদি দিয়ে পটলের খাটুমিঠু।
‘আজ এই পর্যন্ত’ লিখেই মনে হল, এ মা মুম্বইয়ের নরিম্যান পয়েন্টের এক দোকানে খাওয়া কাগজি বাদাম, কাজু, পেস্তা, মনাক্কা, পোস্ত, গলাপ পাপড়ি, এলাচ দানার সঙ্গে গরুর দুধ দিয়ে তৈরি ঠাণ্ডাইয়ের কথা তো বলা হল না। আর কিছু বলছি না, পরীক্ষা পার্থনীয়। আপনার যাত্রা শুভ হোক। দুগগা, দুগগা।
~~ বিকাশ মুখোপাধ্যায়