Pice Hotel : পাইস হোটেল

22 Jun 2024 | Comments 0

 

হরেকৃষ্ণের সঙ্গে আমার পরিচয় হল নবদ্বীপে। সেখানে টোটো চালায় ও। সম্প্রতি একটা কাজে যেতে হয়েছিল নবদ্বীপ। হরেকৃষ্ণর গাড়িতে করেই ঘুরলাম এদিক ওদিক। বাংলার এই সমস্ত পুরনো শহরগুলোর ইতিহাসের আকর হয়ে এখনও দারণভাবে জীবন্ত। হরেকৃষ্ণর সঙ্গে ঘুরছিলাম সেসবের সন্ধানেই। কখনও গঙ্গার ঘাট, কখনও জগন্নাথ মিশ্রর বাড়ি, কখনও আবার সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির। হরেকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা নবদ্বীপের সবার নাম কৃষ্ণের নামে কেন? আমি তো অন্য নাম খুঁজেই পাই না। হরেকৃষ্ণ হাসছিল, ‘আসলে একেক জনের একেক রকম কারণ। আমার বাবা যেমন ভেবেছিলেন, জীবনের শেষ সময়ে আমার নাম ধরে ডাকবেন। আমাকে ডাকাও হবে, আবার কৃষ্ণকে ডাকাও হবে। কিন্তু দেখুন বাবা শেষ জীবনে কথাই বলতে পারল না। আর কৃষ্ণ নাম জপও হল না!’ আমি ভাবছিলাম, সত্যি তো মানুষ ভাবে কত কিছু আর হয় কতটুকু। এই ‘কতকিছু’ আর ‘কতটুকু’র মধ্যে চলাফেরার নামটাই বোধহয় জীবন। হরেকৃষ্ণই সেদিন নিয়ে গেল লক্ষ্মী বোর্ডিংয়ে। আমি ভাবছিলাম, কোনও মন্দিরে নিশ্চয়ই কোনও প্রসাদ পেয়ে যাব। কিন্তু ওই বোঝাল, এখানে এসেছেন যখন, একবার লক্ষ্মী বোর্ডিংটা ঘুরে যান। হরেকৃষ্ণর টোটোতেই গেলাম লক্ষ্মী বোর্ডিংয়ে। দোতলা একটা বাড়ির একতলাটায় থাকার জায়গা, নিচে খাবারের বন্দোবস্ত। ঢোকার মুখেই একটা ক্যাশ কাউন্টার, ভিতরে কয়েকটা প্লাস্টিকের টেবিল, চেয়ার। সাকুল্যে ৫টা টেবিল, গোটা ২০ চেয়ায়। কোনও টেবিল খালি নেই। লাল সিমেন্টের মেঝে। পাশেই রান্না হচ্ছে। কয়েকজন জন মহিলা কর্মী পুরো হেঁশেলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। খাওয়ার জায়গার ঠিক পাশেই একটা ঘরে কালো রঙের একটা ল্যাব্রাডর আটকানো। এত লোকের মাঝে তাকে এভাবে আটকে রাখা তার একদম পছন্দ নয়। অথচ তার চিৎকারেই এলাকা জমজমাট। মালিক তপন দত্ত একটা হাফ প্যান্ট আর গলায় গামছা জড়িয়ে ভয়ঙ্কর ফ্যাশন কম্বিনেশনে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে বসে। ক্যাশ সামলাচ্ছেন তাঁর ভাইপো আর ছেলে সামলাচ্ছেন কাস্টমারদের। লক্ষ্মী বোর্ডিংয়ের এই ক্যান্টিন চালু করেন তপনবাবুর বাবা হরিমাধব দত্ত আর দাদা দেবদুলাল দত্ত। তাদের দুটো ছবি ক্যান্টিনের দেওয়ালে টাঙানো। কী খাবেন? তপনবাবুর ছেলে এসে অর্ডার নিয়ে গেলেন। আমার আর হরেকৃষ্ণর অর্ডার হল, আড় মাছ আর মাটন। অবশ্য তার আগে ভাত, ডাল, আলু ভাজা আর কাটোয়ার ডাঁটার একটা তরকারি এসে গেছে। ডালে চুমুক দিয়েই ততক্ষণে বুঝে গেছি, আজ অসাধারণ কিছু অপেক্ষা করছে আগামী আধঘন্টায়। শেষ পাতে আমের চাটনিটা অবধি তাই হল। কিন্তু সব ছাপিয়ে গেল মাটনটা। তপনবাবু বললেন, আসলে রান্নার মালমশলার ক্ষেত্রে আমরা কোনও কম্প্রোমাইজ করিনা। মাটন বলুন আর মশলাই বলুন, কেনাকাটাটা একদম নিজেদের। কোনও গুঁড়ো মশলার ব্যাপার নেই, সবটাই বেটে। আর সেখানেই তো স্বাদের আসল রহস্যাটা লুকিয়ে। জিভের প্রতিটা স্বাদকোরকের সঙ্গে মশলার প্রেম। প্রতিটা কোষে যেন মিশে থাকবে মশলাগুলো, সম্পৃক্ত হয়ে। লক্ষ্মী বোর্ডিং আর ক্যান্টিনের মাটনটা যেন আরেক প্রেম কাহিনি। মাংসগুলো কখন যেন গলে গেল এই প্রেমের উষ্ণতায়। হবে নাই বা কেন নবদ্বীপ তো প্রেমের শহরই।
মাংসের গন্ধটা এক ঝকটায় এনে ফেলল বকখালিতে। তারও সপ্তাহখানেক আগে ঠিক এই মাংসের ঝোলটাই তো খেয়ে এলাম বকখালিতে। আমাদের বেড়ে ওঠা মফস্‌সলে, খুব শীতের রাতে বিয়েবাড়িতে গরম ভাতের সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা মাটন পড়ত পাতে। চারপাশটা সুগন্ধে ভরে যেত। বকখালিতে যেন সেদিন একটু শীত, শীত। অঝোরে বৃষ্টি সন্ধে থেকেই। সন্ধের একটু আগেই আবশ্য আমরা বিচ থেকে ফিরেছি। ‘আমরা’ মানে আমরা সবাই। আমাদের গ্রেমাইন্ড পরিবরের সবাই। গত বছর গেছিলাম সুন্দরবন। এবার বকখালি। অফিসের কাজের নানা ব্যস্ততা, পাহাড় প্রমাণ চাপের মাঝে দু’দিন অন্যরকমভাবে কাটিয়ে আসা। যাদের সঙ্গে বছরের সবচেয়ে বেশি সময়টা কাটে, যাদের সঙ্গে প্রতিদিনের রাগ, অভিমান, ঝগড়া, ভালবাসা- তাদের সঙ্গেই বেড়াতে যাওয়া সাগরে। বকখালিতে নেমে অবশ্য প্রথমে মন খারাপ হয়ে গেছিল। কোথায় দীঘা, মন্দারমণি- আর কোথায় এই দুয়োরানি। নানা কারণে বাংলার এই সমুদ্র সৈকত মানুষের হ্যাপি ডেস্টিনেশন হতে পারেনি। প্রথমত, শীতকালে সমুদ্র অনেক দূরে সরে যায়। আর বর্ষাকাল ছাড়া সমুদ্রে সেভাবে ঢেউ নেই। একটা সময় বকখালির চারদিকে ছিল বিস্তীর্ণ ঝাউবন। আয়লা আম্ফানের পর সেসবও অতীত। তবে বকখালির আকর্ষণের সবটাই হল, এর বিস্তৃত বিচ আর এক টুকরো নির্জনতা। আকাশের মুখ ভারী ছিল সকাল থেকেই। ধূসর মেঘের ক্যানভাসটা সমুদ্রে মিশে গেছিল দূরে কোথাও। বৃষ্টির বার্তা নিয়ে হাওয়া চলছিল এলোমেলো। আর এরই মাঝে আমাদের এলোমেলো ফুটবলও শুরু হল। এলোমেলো মানে অতীতকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্ট। আমাদের দলে কুড়ি পার হওয়া দামাল আছে, আবার পঞ্চাশ পার হওয়া মাঝবয়েসি সংস্কৃতিতে হাঁফিয়ে ওঠা প্রাণও আছে। তাদের সবাই মিলে শুরু হল ফুটবল। সে খেলা যেন থামাতেই চায় না। থামল যখন সূর্য চলেছে পশ্চিমের দিকে। তারপর আবার সমুদ্র স্নান। শেষে হোটেলের দিকে যাত্রা। রাতের খাবারের সময়টা যেন দ্রুত চলে এল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। আমরা হাজির বনশ্রী রেস্তোরাঁয়। এয়ারকন্ডিশন কাচের একটা বড় ঘর। বকখালির অন্যান্য হোটেলগুলো থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। হোটেলের মালিক রামপ্রসাদকে সকালে দেখেছিলাম, পুজো সেরে বাবার মূর্তিতে পুজো সারলেন। বাবা ধীরেন্দ্রনাথ গিরি ছিলেন এই হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁরই একটা আবক্ষ মূর্তি রয়েছে হোটেলে ঢোকার মুখেই। রামপ্রসাদ গল্প করছিল ‘১৯৭২-এ যখন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বকখালিতে ট্যুরিজমের তিনটি গেট হাউস চালু করলেন, তখন গোটা এলাকাটা ফাঁকা। বাবা সে বছরই এই ভাত খাওয়ার হোটেলটা চালু করেন। আর এখন বকখালিতে প্রায় আড়াইশোর বেশি হোটেল।’ এ হোটেল এখন দেখেন রামপ্রসাদের স্ত্রী। রান্নার দেখভাল থেকে অতিথি আপ্যায়ন- সবটা তাঁর দায়িত্বে। লাঞ্চ আর ডিনারে উপচে পড়ছে মানুষ। আমাদের অর্ডার ছিল কাঁকড়া, চিংড়ি আর মাটন। সমুদ্রের ধার থেকে কাঁকড়া আর চিংড়ি চলে এসেছিল। লাঞ্চে সেসব দিয়ে কত থালা ভাত যে জাস্ট উধাও হয়ে গেছে, কে বলতে পারে। রাতে এল মাটন। একদম গরম। আর বাইরের তাওয়া থেকে সেঁকা গরম রুটি। বৃষ্টি কমছিলই না। নির্জন বকখালির বুকে আরও জমাট বাঁধছিল নির্জনতা। একটু শীত, শীত। আর সে সময়ই সেই মাংসটা। আমাদের মফস্‌সল শহরের শীতের রাতের সেই ডেলিকেসি। তখন দল বেঁধে খাওয়ার সময়। ভাবতে ভাল লাগে, চল্লিশ পার হয়েও দল বেঁধেই আছি। চালসে আছে, চোখ থেকে খসে পড়া চশমাটাও আছে, কিন্তু নিরালা সফরটাও হয়নি। পাশে কত বন্ধু, সহকর্মী, ভালবাসার মানুষ। কতকিছু, কতটুকুর সঙ্গে প্রাপ্তির ব্যালেন্স শিটে ‘এতটুকু’ সঞ্চয় হলেই জীবনে আর পিছন ফিরে তাকানোর দরকারই নেই।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হ্যাংলা শো-কেস

সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের অনলাইন স্টোরে আপনাকে স্বাগতম

1
Latest Magazine