Hangla Hneshel Celebrate Hilsha Fastival: ইলিশ উৎসব ও হ্যাংলা পরিবার

11 Aug 2024 | Comments 0

ফোনটা আসত ঠিক এইভাবে। ‘তুমি কে বলছো বাবা।’ ফোনের অন্যপ্রান্তে এক প্রৌঢ়ার কৌতুহলি কন্ঠস্বর।আমি বলতাম, আপনি কাকে খুঁজছেন’? উনি বলতেন, ‘আমি তো আমার ছেলেকে ফোন করতে চাইছিলাম। জানিনা, কোথায় চলে গেল।বয়েস হয়েছে তো, ঠিক বুঝতে
পারি না।’ আমি বললাম, ‘না মাসিমা, এটা আপনার ছেলের নম্বর নয়। ভুল নম্বর ডায়াল হয়ে গেছে। দু’দিন পর পরই আবার ফোন। একই কথা। আমারও একই উত্তর। বেশ অপ্রস্তুত, লজ্জিত হয়েই ফোন ছাড়তেন বুঝতাম। আমি বরং বলতাম, ‘না না কোনও ব্যাপার না। ভুল তো হতেই পারে।’ তারপর একদিন মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী।’ নাম বললাম। মাসিমা বললেন, ‘আমার ছেলের নাম অমিত। ওকে ফোন করতে যাই। কী করে যে তোমার কাছে চলে যায়। মাসিমার ‘রং’ নম্বর পর্ব আরও বেশ কিছুদিন চলল। একদিন। আবার নম্বর ডায়াল করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা তুমি থাকো কোথায়?’ আমি বললাম, ‘যাদবপুর। কিন্তু আপনি কোথায় থাকেন। মাসিমা জানালেন, ‘দক্ষিণেশ্বর’। দক্ষিণেশ্বর! সে তো আমার আদি জায়গা। শিকড় এখনও ওখানেই পোঁতা রয়েছে। মাসিমাকে বললাম, দক্ষিণেশ্বরের কোথায়? বললেন, ‘বাচস্পতি পাড়া’। আরে, সেটাও তো আমার যাতায়াতের রাস্তা। বাড়ি ফিরলে ওটা দিয়েই ফিরতে হয়। মাসিমার সঙ্গে তারপর যোগাযোগও বের হল বিস্তর। আমার কাকা, পিসি সবাইকে ভালভাবে চেনেন। একসময় উত্তর ২৪ পরগনার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় কমিউনিষ্ট নেতা লক্ষ্মীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রাতৃবধূ হলেন তিনি। এর মাঝে মাসিমার ফোন নম্বর আমার ফোনবুকে সেভ হয়ে গেছে। ‘রং নম্বর মাসিমা’। মাসিমারও আর রং নম্বর হয় না। আমাকে ফোন করবেন বলেই ফোন করেন। নিয়মিত খোঁজখবর নেন। বেশ কয়েকবার মসিমার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আমি গেলেই লাঠিতে ভর দিয়ে বসার ঘর অবধি হেঁটে বেরিয়ে আসেন। খুব খুশি হন। বারবার বলেন, ‘আমার এখন দুই ছেলে । তুমি আমার ছোট ছেলে।’ ইদানিং মাঝেমাঝেই বলছিলেন, ‘তুমি একদিন এসে আমার কাছে খাবে। খাবে তো’। মাসিমাকে কী করে বোঝাই, আমি বিশ্ব হ্যাংলা। আর নেমন্তন্ন পেলে আমি সচরাচর না বলি না। মেনু সিলেকশনেও আমার ইনপুট থাকল। বর্ষাকাল, তাই শুধুই ইলিশ মাছ। মাছ ভাজা, দই ইলিশ, বেগুন ইলিশ ইত্যাদি। দারুণ রেঁধেছিলেন অমিতদার স্ত্রী। যতক্ষণ খেলাম, ঠায় বাসে থাকলেন মাসিমা। মুখে অনেকটা তৃপ্তির হাসি। ঠিক যেমন আমার মা বসে থাকত খাবার টেবিলের পাশের চেয়ারে, সারাক্ষণ। বাবা একটা কথা বলতেন প্রায়ই। ‘ সম্পর্ক হল ঢেউয়ের মতো। ভাঙে, আবার গড়ে। আবার ভাঙে, আবার গড়ে।’ আর ঠিক এভাবেই একটা রং নম্বর, সম্পর্কের রঙমশাল জ্বালিয়ে দেয় হৃদয়ে’। মাকে হারিয়েছিলাম বছর দেড়েক আগে। এখনও আমার বাড়ির সর্বত্র বোধহয় মায়ের গন্ধ ছড়ানো। বিশ্বাস করুন, সেদিন ইলিশের গন্ধ দমকা বাতাসের মতো উড়িয়ে দিচ্ছিল মা আর সন্তানের সম্পর্কের চেনা গন্ধটাই। পৃথিবীতে এভাবেই বেঁচে থাক বাক সব সম্পর্কগুলো। সুন্দরভাবে।
বছরের এই সময়টা ইলিশের মাস। যে কোনও উদযাপনেই ইলিশ মাস্ট। সম্পর্কের আরও একটা উদযাপন আমরা সেরে নিলাম ইলিশ দিয়েই। হ্যাংলা পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে ঘুরে এলাম সুন্দরবন। অসাধারণ কাটল কয়েকটা দিন। প্রতিটা মুহূর্ত স্মৃতিতে সজীব রেখে কাটিয়ে দিতে পারি বাকি জীবনটা। দু’দিকে যেখানেই চোখ যায়, শুধু জল। ভরা কোটালে জল উপচে পড়ে ভাসিয়ে দিয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সবুজ। দিগন্তে এই অনন্ত জলরাশি মিশে গেছে আকাশের সঙ্গে। আকাশে কখনও উঁকি মারে কালো মেঘ, কখনও আবার রোদ হেসে উঠে চোখে ঝিলমিল লাগিয়ে দেয়। গোটা আকাশ যেন বলগাহীন কোনও শিল্পীর ক্যানভাস। রঙ ছড়িয়ে গেছেন দু’হাতে। তারই মাঝে আমাদের লঞ্চ এগোয় সোনাখালি, ঝড়খালি, দোবাঁকি সজনেখালি, গোসাবায় নোঙর ফেলে। ডেকেই খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। সারেঙরা রান্না করছেন। ইলিশ মাছ, খিচুড়ি, বাগদা চিংড়ি, ভোটকি, পাবদা, আমোদি- কত কিছু। সন্ধে নামার আগেই আমাদের লঞ্চের পিছনে কয়েকটা শঙ্খচিল। জমাট নৈঃশব্দ ভেঙে যায় তাদের চিৎকারে।আমাদের লঞ্চে কেউ গেয়ে ওঠে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান। ‘আমার দু’ডানায় ঢেউয়ের দোলা, আমার দু’চোখে নীল, শুধু নীল’। কখনও আবার সবাই মিলে গেয়ে ওঠা ‘ভেবে দেখেছো কী তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে’। তারপর সুন্দরবনের আকাশে চাঁদ ওঠে। তারারা চলে আসে হাতের কাছে। ঘুচে যায় সব দূরত্বগুলো। বিস্তীর্ণ সবুজ চরের মতো শুধু জেগে থাকে সম্পর্কগুলোই। একজনের সঙ্গে অন্যের। এক আত্মার সঙ্গে অন্য আত্মার। পাশাপাশি টেবিলে যে আত্মীয়রা, সহযোদ্ধারা লড়াই চালায় সারা বছর। বেঁচে থাক এইটুকুই, বেঁচে থাক জীবনের সম্পর্কগুলো।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হ্যাংলা শো-কেস

সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের অনলাইন স্টোরে আপনাকে স্বাগতম

1
Latest Magazine