পুরুষ সাবধান। না, আমি বলছি না। বলছে ভারতের একটা বিখ্যাত ঘটকালির ওয়েবসাইট। ওই ওয়েবসাইটের তরফে মহিলাদের মধ্যে একটা সমীক্ষা চালানো হয়। ৩৯.৫ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন, তাঁদের জীবনসঙ্গীকে রান্নাবান্না শিখে তবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে। অর্থাৎ কী বুঝলেন? শুধু • পড়াশোনা শিখে ভাল চাকরির সন্ধান করলেই হবে না, মাঝে টুক করে চলে যেতে হবে কোনও কুকিং ক্লাসে। রান্নার এ টু জেড অবধি শিখে তবেই সুপাত্রীর সন্ধান পেতে পারেন। হবু শাশুড়িরা যাঁরা ভাবছেন এবার বাড়িতে পুত্রবধূ আনবেন, দয়া করে সমীক্ষাটা মাথায় রাখবেন আর ছেলেকে সময় করে একটু রান্নাবান্না শেখাবেন। তবে স্বস্তির কথা একটাই, অনেক হবু পাত্রই এখন বুক বাজিয়ে বলতে পারে, রান্নাটা আমিও পারি। অনেকের চেয়ে ভালই পারি। হবে নাই বা কেন? সেই মহাভারতের ভীম থেকে আজকের বিখ্যাত শেফ- রান্নাঘরে কিন্তু পুরুষরাই সাম্যবাদ এনে দিয়েছেন। হ্যাংলা হেঁশেলের একেবারে প্রথম সংখ্যা থেকে ‘হেঁশেলের ভানুমতী’ নামের রেসিপি কনটেস্ট চালু রেখেছি আমরা। এই ভানুমতীদের হেঁশেলে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু চারপাশে এইসব সমীক্ষা-টমীক্ষা দেখে মনে হচ্ছে, বাড়ির ভজহরিবাবুদের জন্য কিছু ব্যবস্থা থাকা দরকার। তাই হ্যাংলার পাতায় আগামী সংখ্যা থেকেই শুরু হচ্ছে মিস্টার মায়াদের রেসিপি প্রতিযোগিতা। এটা পুরুষদের প্রতিযোগিতা। মহিলাদের প্রবেশাধিকার নেই।
প্রখ্যাত রন্ধন বিশেষজ্ঞ তারলা দালালকে কে রান্না শিখিয়েছিলেন, জানেন? তাঁর স্বামী নলিন দালাল। আমেরিকায় থাকতেন ওঁরা। টানা নয়টা বছর প্রবাসে রান্নাবান্না নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা চলতে থাকে এই দম্পতির। স্বামী ছিলেন রান্না নিয়ে রীতিমতো উদ্যমী আর খুঁতখুঁতেও। রান্নার বই কিনে আনতেন তিনিই। সেগুলো নিয়ে চলত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রান্না নিজেদের পছন্দ না হলে নতুন করে আবার সেই একই রান্না হত। এভাবেই তারলা দালাল হয়ে গেলেন হেঁশেলের ভানুমতী। মুম্বইতে ফিরে কুকিং ক্লাস চালু করেন তারলা। মাত্র ৬ জন ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয় সেই ক্লাস। সেটা ১৯৬৬-র কথা। পরবর্তীকালে এই ক্লাসের বাইরেই ভর্তি হওয়ার লম্বা লাইন থাকত। ১৯৭৪-এ প্রথমবার খাওয়াদাওয়া নিয়ে বই লিখেছিলেন তিনি। ২০১৩ অবধি তাঁর বইয়ের সংখ্যা দেড়শোরও বেশি। ২০০৭ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রীও। খাওয়াদাওয়া জগতের এই কিংবদন্তিকে অবশ্য দীপাবলির পরই হারালাম আমরা। কিন্তু একটা উত্তরাধিকারকে অবশ্যই রেখে গেলেন তিনি। শুধুই রান্না নয়, তোমার হাসিমুখ, তোমার শরীরী ভাষা, তোমার অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা সবটা মিলে স্বাদকোরকদের উজ্জীবিত করে তোলে।
বিশ্বাস করুন, এই সবটা মিলিয়ে তবেই খাওয়াদাওয়া। তবেই একটা সংস্কৃতি। ফুড মানে শুধুই কিছু রেসিপি নয়। কিছু মশলাপাতির সমাহার নয়। ফুড মানে একটা লাইফ স্টাইলও। টিএলসি থেকে ফুড ফুড, টিভি চ্যানেলগুলোয় দেখুন, নেহাতই রেসিপি ক্লাস চলছে না কোনওটাতেই। বরং খাবারের সন্ধানে ওঁরা বেরিয়ে পড়েছেন। তল্লাশি চালাচ্ছেন। রসনার, জীবনেরও। নিজের অভিজ্ঞতা বলতে হচ্ছে। আগেও এই কলমে লিখেছিলাম পাকিস্তানের কথা। পাকিস্তানের পেশোয়ারে নমকমন্ডি বলে এক মহল্লা আছে। ‘পাকিস্তানের কাবাব পাড়া। প্রবল বিখ্যাত খাবার হল ‘দুম্বে কা গোস্ত’। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এসে খাটিয়ায় পা তুলে বসে একটা পাত্রে ‘দুম্বে কা গোস্ত’ রেখে তন্দুরি রোটি সহযোগে ভাগ করে খাচ্ছেন। এক একটা খাটিয়া ঘিরে প্রায় জনা দশেক মানুষ। ওদের জীবনযাত্রাটাই ওরকম। কিংবা সম্প্রতি ঘুরে এলাম লক্ষ্ণৌর কাবাব মহল্লাগুলোয়। নবাবদের উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে যাচ্ছে দোকানগুলো। লক্ষ্ণৌ চকে বসে ধোঁয়া ওঠা কাকোরি কিংবা গলৌটি কাবাবে কামড় দিলে নিশ্চিতভাবে অনুভব করবেন, আপনি এখন আওয়াধ রাজ্যে। ফিরে গেছেন আড়াইশো বছর আগে, নবাব আসাফউদৌল্লার সময়ে। আওয়াধি ফুড নিয়ে সত্যি কত আলোচনা, কত গবেষণা। কলকাতায় আড়াইশো বছর আগে, নবাব আসাফউদৌল্লার সময়ে।
আওয়াধি ফুড নিয়ে সত্যি কত আলোচনা, কত গবেষণা। কলকাতায় তো আওয়াধি খাবার নিয়ে আলাদা রেস্তোরাঁই খুলে গেছে। গোটা লক্ষ্ণৌ, পুরনো মহল্লাগুলো এখনও যেন সেই ট্র্যাডিশন নিয়ে বসে আছে। বিরিয়ানি, কাবাব, নিহারি, জর্দা সবেতেই যেন কোথাও একটা অভিনবত্বের চেষ্টা। মোগলাই খানা আর আওয়াধির তফাতটাও ওটাই। রন্ধন প্রণালীতে। প্রতিটা খাবারই ওঁরা ‘দম’ পদ্ধতিতে তৈরি করেন। অর্থাৎ কম আঁচে তৈরি হয় সবকিছু। মোগলাই খাবারের মতো প্রচুর মশলার সম্ভার থাকে না আওয়াধিতে। কিন্তু যা থাকে সবটাই, এক্সক্লুসিভ। মোগলাই কাবাব আপনি পাবেন তাওয়ায় তৈরি।
Editorial : সাম্যবাদের গল্প
Read Time:6 Minute, 50 Second