Editorial: অর্গানিক ফুড ও আমরা

17 Nov 2024 | Comments 0

বাসন্তী ব্রিজটা পার হতেই যেন সুন্দরবন থেকে আসা ভিজে, বুনো, নোনা গন্ধটা নাকে লাগল। বাসন্তীর দু’কূল ছাপিয়ে তখন বৃষ্টি নেমেছে। আমাদের গাড়ি থামল বাসন্তী গার্লস হাইস্কুলের মাঠে। স্কুলের ভিতর আমাদের জন্য তখন অপেক্ষায় সজল দেব আর তাঁর স্ত্রী। সজলবাবু খেলাধূলার জগতের লোক। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজনদের নিয়ে ফুটবল ক্যাম্প চালান। ফুটবলার তৈরি করেন। আমাদের গোটা ইউনিটের লাঞ্চের দায়িত্বে সেদিন দেব দম্পতি। স্কুলের বেঞ্চে পাতা সারি সারি ভিজে শালপাতার সঙ্গে কখন যেন মিশে গেল গরম ভাতের গন্ধ। আর পাতের পাশে এসে পড়ল ডিমভরা ট্যাংরার ঝাল আর বাগদার মালাইকারি। এরকম একটা হ্যাংলা দুপুরের জন্য বাসন্তী কেন, সুন্দরবনের গভীরে যেতেও বোধহয় বুক কাঁপবে না কোনও পেটুক বাঙালির। বাগদার খোঁজে আমরাও সেদিন তাই চলে গেলাম ঝড়খালি। সন্ধে নেমেছে। লণ্ঠন উস্কে থার্মোকলের বাক্স থেকে একটার পর একটা গলদা আর বাগদা বার করছিলেন স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। লণ্ঠনের মৃদু আলো ঠিকরে চকচক করছিল দোকানের ভিতরটা। কোনওটার গায়ে শ্যাওলা রঙের প্রলেপ, কোনওটা রুপোলি।
বাসন্তী ঝড়খালির ওই দুপুর আর বিকেলটা সত্যি মনে রাখার মতো। ঝড়খালি বাজারেই সজলবাবু ব্যবস্থা করে দিলেন খাঁটি মধুর। গলায় ঢাললে অমরত্ব প্রাপ্তিটা প্রায় নিশ্চিত। গলায় একটু জ্বালাও করবে, তবে ওটাই নাকি খাঁটিত্বের পরিমাণ। সুন্দরবনের গভীর থেকে মউলেরা যে মধু সংগ্রহ করে আনেন, সেগুলো ঝড়খালি কিংবা সজনেখালির এ-সব অঞ্চল থেকে যায় কোথায়! কারা নিয়ে যায়? কী হয় এ-সব আসল মধু দিয়ে? আসলের কথা বলতেই হচ্ছে, ভাবতেই হচ্ছে কারণ আমাদের দেশে বিভিন্ন বিখ্যাত কোম্পানির মধুতেও ভেজাল পাওয়া গেছে। ভাবতে পারেন, বেবিফুড থেকে ডাক্তারি পথ্য সর্বত্র ব্যবহৃত হয় যে মধু, তাতেও ভেজাল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, আমেরিকা-চীনের বাজারগুলোয় ছেয়ে গেছে নকল মধু, যার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে কীটনাশক, এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকসও! ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ভারত আর চীনে তৈরি মধুর ওপর ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেছে। আর এই মধুই বিভিন্ন ওষুধের দোকান কিংবা রিটেল শপ থেকে কিনে খাচ্ছি আমরা। অথচ অর্গানিক মধুর এতবড় সম্ভার আমাদের হাতের কাছে। সুন্দরবনের মধু নিয়ে সত্যিই বড় কিছু ভাবা যেতেই পারত। আসলে গোটা পৃথিবী জুড়ে এখন অর্গানিক ফুড নিয়ে দারুণ সচেতনতা তৈরি হয়ে গেছে। কীটনাশক কিংবা রাসায়নিক দিয়ে তৈরি খাদ্য যে শরীরকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল প্রায় সবাই। তাই চা থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য অর্গানিক পদ্ধতিতে উৎপাদনে সাড়া বাড়ছে। আপনি উত্তরবঙ্গে যান, ইদানীং বেশ কিছু অর্গানিক চা-বাগান পাবেন, যেখানে কীটনাশকের বদলে চা গাছের চারপাশে তুলসী গাছের সন্ধান মিলবে। কীটনাশকের কাজটা তুলসী থেকেই নাকি হয়ে যায়! আর সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জৈব খাদ্যের বাজারও বাড়ছে। ২০১০ সালে ভারতে অর্গানিক ফুড মার্কেট ছিল ৬৭৫ কোটি টাকার। বলা হচ্ছে, ২০১৫-র মধ্যে এটা দাঁড়াবে ৭০০০ কোটি টাকার। অর্থাৎ গ্রোথ পার্সেন্টেজ প্রায় ২৫০ শতাংশ। এখন ভারতের অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ রপ্তানি হয়ে যায়। ১৫ শতাংশ লাগে ভারতীয়দের প্রয়োজনে। কোনও সন্দেহ নেই, প্রয়োজনটা ক্রমেই বাড়বে।
একসময় ভারতীয়রা গোটা বিশ্বকে শিখিয়েছিল জৈব পদ্ধতিতে জীবনযাপন। দুঃখের বিষয় যে ভারতকে আবার পুরনো মতাদর্শ, সংস্কৃতি আর অভ্যেসে ফেরার চেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু যাঁরা এই পদ্ধতিতে বিশ্বাস রাখেন, তাঁরাও কিন্তু স্বাদে, রসনায় কিংবা ব্যবসায় পিছিয়ে নেই। কলেজ স্কোয়্যারে প্যারামাউন্টের মৃগেনবাবুরা শুরু করেছেন নতুন শরবত লিচু স্পেশাল। সেদিন প্যারামাউন্টে ঢুকতে নিজেই খাওয়ালেন। লিচুর রস থেকে তৈরি করছেন শরবত। নিশ্চিত থাকতে পারেন, বাজার চলতি যে-কোনও লিচি ড্রিঙ্কসের চেয়ে কয়েকগুণ ভাল এই অর্গানিক শরবত। প্রকৃতি থেকে অকৃত্রিমভাবে পাওয়া কোনওকিছুরই বোধহয় কোনও তুলনা হয় না।
কয়েকদিন আগে মণিপুর যেতে হয়েছিল। কাজের ফাঁকে চলে গেছিলাম লোকটাক লেক আর সাডু চিরু ওয়াটার ফলস্ দেখতে। প্রকৃতি আর মানুষের মেলবন্ধন আবার মনে পড়িয়ে দিল মণিপুর। লোকটাকের জলে ভাসতে থাকা ডিঙি নৌকায় মাছ ধরে ধরে ঘরে ফেরা জেলে কিংবা রাস্তার ধারে শুকনো মাছের ডালা নিয়ে বসে থাকা মণিপুরি রমণী- সত্যি প্রকৃতির মধ্যেই বাস করেন ওঁরা। সাডু চিরু পাহাড়ে ওঠার আগে দেখতে পাবেন পাহাড়ি লোকজন বিক্রি করছেন পাহাড় থেকে তুলে আনা ফল, সবজি। পাহাড়ে ওঠার রাস্তায় বিক্রি হচ্ছিল স্থানীয় দেশি মদ- আথিংবা। বিভিন্ন ফ্লেভারে। প্রচুর মানুষ কিনছিলেন। পাহাড়ে ওঠার মুখেই লেখা, মা প্রকৃতিকে নষ্ট করো না, নোংরা করো না। স্থানীয়রাই লিখেছেন। ওঁরা জানেন, প্রকৃতিকে নিয়ে ওঁদের বেঁচে থাকতে হবে। প্রকৃতিই মা, প্রকৃতিই ঈশ্বর।
সাডু চিরু পাহাড়ে ওঠার সময় তাই উত্তরাখণ্ডের কথা বারবার মনে হচ্ছিল। ইস্, উত্তরাখণ্ডের লোকেরা যদি বুঝতেন। বুঝলে এত বড় বিপর্যয় বোধহয় হত না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হ্যাংলা শো-কেস

সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের অনলাইন স্টোরে আপনাকে স্বাগতম

1
Latest Magazine