একদিকে পাশাপাশি তিনটে চেয়ারে বসে চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি, রাজেন্দ্র প্রসাদ আর পণ্ডিত নেহেরু। উল্টোদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন আর লেডি মাউন্টব্যাটেন। বিদায়ী ভাষণ দিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন রাজা গোপালাচারি। হেড বাটলারের নির্দেশে ডিনার সার্ভ হল। খাওয়া শেষে ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়ে গেলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। বেরিয়ে গেলেন ভাইসরয় হাউস থেকে, ভারত থেকে। লম্বা ঘরটায় দাঁড়িয়ে এরকম কিছু দৃশ্যই কল্পনা করছিলাম বোধহয়। কল্পনা নিছকই কল্পনা। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সম্মানে এরকম কিছু অফিসিয়াল ফেয়ারওয়েল ডিনার হয়েছিল কিনা সত্যিই জানা নেই। হওয়াটাও অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে ওই ঘরটায় ঢুকে এভাবেই ইতিহাসে ভেসে যেতে হবে। এই ব্যাঙ্কোয়েট হলটায় কত কূটনৈতিক সভা, রাজনৈতিক দৌত্য আর ইতিহাসের পালাবদল। নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে আজকের ওবামা, কে বসেননি ওই লম্বা কাঠের ডাইনিং টেবিলটার সামনে। টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়েই আমাদের নানান তথ্য দিচ্ছিলেন রাষ্ট্রপতি ভবনের এক কর্মী। রাইসিনা হিলসের ঐতিহাসিক ব্যাঙ্কোয়েট হলে তখন আমরা। ওই টেবিলটায় মুখোমুখি ১০৪ জন বসতে পারেন সব মিলিয়ে। কাঠের চেয়ারগুলো সব একইরকম। শুধু মাঝের রাষ্ট্রপতির চেয়ারটা আলাদা। আর উল্টোদিকে যে রাষ্ট্রদূত বসবেন, তাঁর চেয়ারটাও অন্যরকম। তবে রাষ্ট্রদূত মানে শুধু রাজা কিংবা অন্য কোন দেশের প্রেসিডেন্টকেই রাষ্ট্রপতি ডিনারের আমন্ত্রন জানাতে পারেন। অন্য রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী এলে তাঁকে ডিনারে ডাকবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
৩২০ একর জুড়ে ছড়ানো আমাদের প্রেসিডেন্টের বাড়িতে এরকমই নানাবিধ প্রটোকলের ছড়াছড়ি। প্রণব মুখার্জির প্রাসাদে যাবার সুযোগ হয়েছিল বন্ধু কৌশিকের সুবাদে। কৌশিকই সঙ্গে দিলেন প্রেসিডেন্ট হাউসের এক কর্মীকে। স্যার এডউইন লুটিয়েনসের স্থাপত্য ঘুরে দেখালেন তিনিই। প্রথমে দরবার হল। ঠিক যেখানে ১৪ অগাস্টের মাঝরাতে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছিল, সেই হলটা। ৬০০ জন মতো বসতে পারেন ওই হলে। মাঝে ছোট্ট একটা মঞ্চ। তাতে একটাই চেয়ার রাখা। রাষ্ট্রপতির জন্য। তার পিছনেই বুদ্ধের একটা মূর্তি। গুপ্তযুগের এই মূর্তিটা পাওয়া গেছিল মথুরায়। তারপর কলকাতা জাদুঘর ঘুরে আপাতত দরবার হলে রয়েছে। আমাদের গাইড বললেন, বুদ্ধের পায়ের পাতা আর উল্টোদিকেরা ইন্ডিয়া গেটের মাথা এক উচ্চতায় রয়েছে। কারণ একটাই, রাষ্ট্রপতি ভবন তৈরি হয়েছিল রাইসিনা হিলস কেটে। কয়েক পা হেঁটে আশোকা হল। ভাইসরয়দের সময় এটা ছিল ডান্স রুম। কাঠের ফ্লোর। মেঝেতে পারস্য থেকে আনা কার্পেট পাতা। আর সিলিংয়েও পার্সিয়ান চিত্রকরদের ফুটিয়ে তোলা ছবি। পারস্যের রাজা ফতে আলি শাহ ঘোড়ায় চেপে শিকারে চলেছেন। অশোকা হলের প্রতিটা প্রান্ত থেকে সেটাই দেখা যায়। চারপাশে বেলজিয়াম কাচের বড় বড় আয়না লাগানো। ঝাড়বাতি ঝুলছে। রাজকীয় এই হলটা ব্যবহার করা হয় রাষ্ট্রপতি ভবনের বিভিন্ন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে চা চক্রের আসর বসে বাইরের লবিতে। আর ডিনার হলে তারই পাশের ব্যাঙ্কোয়েট হলে। ১০৪ ফিট লম্বা, ৩৪ ফিট চওড়া হল। দেওয়ালে দেশের বিভিন্ন সময়ের প্রতিটি রাষ্ট্রপতির তৈলচিত্র ঝোলানো। রাজেন্দ্র প্রসাদ থেকে প্রণব মুখার্জি সবার। তবে এ পি জে আবদুল কালাম, প্রতিভা পাটিল আর প্রণববাবুর ছবি ব্যাঙ্কোয়েটে জায়গা পায়নি। রয়েছে পাশের লবিতেই। দেওয়ালে পরপর রয়েছে একই সঙ্গে লাল, সবুজ আর নীল আলো। রাষ্ট্রপতির অতিথিরা যখন চেয়ারে বসেন, তখন তাঁদের দেখাশোনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন বাটলাররা। হেড বাটলার তাঁদের নির্দেশ দেন ওই তিনটে আলো মারফত। সবুজ আলো জ্বললে খাবার নিয়ে এগিয়ে যান অতিথিদের দিকে। নীল আলো জ্বললে সার্ভ করেন। আবার খাওয়া শেষ হলে লাল আলো জ্বললে প্লেট সরিয়ে নেন। এভাবেই চলতে থাকে গোটা পর্বটা। মূলতঃ তিন ধরনের খাবার সাভ হয়। প্রথমে সুপ, ব্রেড। তারপর মেইন কোর্স। শেষে ডেজার্ট, চা কিংবা কফি। ব্যালকনি থেকে লাইভ ব্যান্ডের ব্যবস্থাও থাকে। ব্যাঙ্কোয়েটের ঠিক নিচেই রাষ্ট্রপতি ভবনের রান্নাঘর। দেখার সুযোগ হয়নি। তবে শুনেছি এলাহি আয়োজন। নিজস্ব বেকারিও আছে এই কিচেনের সঙ্গে। আর আছে কিচেন মিউজিয়াম। ১৯১১তে কিং পঞ্চম জর্জের সময়ে যখন দিল্লিতে ব্রিটিশ রাজের দরবার স্থানান্তরিত হল, তখন থেকে এখানকার কিচেনে কী কী ব্যবহৃত হয়েছে সব রয়েছে এখানে। তামার পাত্র থেকে রূপোর প্লেট- সব দেখা যায় কিচেন মিউজিয়ামে। ভবিষ্যতে কোন একদিন রাষ্ট্রপতি ভবনের রান্নাঘরটাও দেখার ইচ্ছাটা থাকল, তবে এবারের মতো যা দেখে এলাম, সেই অভিজ্ঞতাটাও আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবার সুযোগটা ছাড়তে পারলাম না।
হ্যাংলার কথায় আসি। হ্যাংলা ক্লাব নিয়ে সত্যি অনেক অনেক স্বপ্ন আমাদের। এই ক্লাব আপনাদের সবার হোক। ফেসবুকে হ্যাংলার পাতায় আপনারা লিখুন আমাদের, কীভাবে আরও সক্রিয় করা যায় হ্যাংলা ক্লাবকে। আর এত মানুষের একটা প্ল্যাটফর্ম শুধু রান্না শেখা আর পরিবেশনে শেষ হয়ে যেতে পারে না। এই সুখাদ্যেই কত কিছু জয় করার আছে। গত মাসে আমাদের সদস্যরা গেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি বৃদ্ধাবাসে। নিজের হাতে তৈরি করে নিয়ে গেছিলেন সেখানকার আবাসিকদের জন্য নানারকম খাবার। পরিবার থেকে দূরে আত্মীয়স্বজনদের থেকে দূরে থাকা ওই মানুষগুলো ওই সুখাদ্যেই আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি করে ফেললেন আমাদের সদস্যদের সঙ্গে। যখন বেরিয়ে আসছি ওখান থেকে, অনেকের চোখে জল। বেদনার, আবার আনন্দেরও। একটা সামান্য প্রচেষ্টায় আত্মীয় পেলেন যে সবাই। এটাই তো আমাদের চেষ্টা। হ্যাংলা সুখাদ্যের মঞ্চ, সুভাবনার মঞ্চ আর স্বজন খুঁজে পাবারও ঠিকানা।
এই ঠিকানায় বারবার ফিরে আসুন আপনারা। আমরা অপেক্ষায় আছি।
Editorial: সম্পাদকীয়
Read Time:8 Minute, 44 Second