Editorial : পিসিমণি ও তার রহস্যময় রান্নাঘর
পিসমণিকে মা সারদার মতো শাড়ি পরিয়েছিল ওরা। পিসিমণির ছবিটাকে। সামনে সাদা ফুলের স্তূপ। ছবির পিসিমণি লালাপাড় সাদা শাড়ি পরে চেনা মেজাজ যেন সবকিছুর তদারকিতে। ঠিক যেমনটা এত বছর দেখে এসেছি। তফাত একটাই, কোনও ডেসিবেলের অত্যাচার নেই। পাড়া কাঁপানো হাসি নেই, বাড়ি কাঁপানো ধমক নেই- সবটাই সাইলেন্স মোডে।
হ্যাংলার এই পাতাটা বিশ্বাস করুন, একান্ত আমার নিজের দুনিয়া। রান্না বিশেষজ্ঞ নই, ফুড কলামিস্টও নই। হ্যাংলা সম্পাদক হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র যোগ্যতা, যথেষ্ট পরিমাণে হ্যাংলামি মজুত জিভের ডগায় কিংবা মস্তিষ্কের কোষে কোষে। আর এই পেটুক দর্শনটাই আমায় হ্যাংলার বিষয় নির্বাচনেও প্রভূত সাহায্য করে। বাকিটা তো হ্যাংলা টিমের ভয়ঙ্কর পরিশ্রম আর প্রতিদিনই একটু একটূ করে নিজের উচ্চতাকে ছাপিয়ে যাবার তাড়না। আর সেটুকুতেই দু’বছর থেকে ঠিক এক কদম পিছিয়ে আমরা। হ্যাংলার পাতায় ইন্ডিয়ান, চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল সব হানা দিয়েছে, কিন্তু এই পাতাটা জায়গা দিয়েছে আমার হৃদয়কে। আমার রাগ, দুঃখ, স্বপ্ন, ভাল লাগা সবকিছু ভাগ করে নিয়েছি এখানে। হ্যাংলার পাঠকদের সঙ্গে। বারাসাতে টিফিন বক্সে শাপলার ঝোল নিয়ে অপেক্ষারত এক সাংবাদিক দিদির কথা যেভাবে বলেছি, সেভাবেই বলেছি বীরভূমের রাস্তার খুঁজে পাওয়া এক রন্ধনশিল্পীর কাহিনি। আবার কোপাকাবানা বিচে বৃষ্টির রাতে ধোঁয়া ওঠা স্যামনের টুকরোয় কামড়ের অনুভূতি ভাগ করে নিয়েছি আপনাদের সঙ্গেই। তাই আশা করি, আবার যদি আবেগের জোয়ার-ভাঁটায় ভেসে যাই, নিজ গুণে মার্জনা করে নেবেন প্লিজ।
আমার বড়পিসি, আমার পিসিমণি চলে গেল ৫ অগাস্ট। ঠিক তিন মাস আগে হ্যাংলার ‘মায়ের হাতের রান্না’ ইস্যুতে পিসিমণির একটা রেসিপি ছাপা হয়েছিল। বাঁধাকপির দই কোপ্তা। ছবি আর রেসিপির সংগ্রহে সেদিন পিসিমণির কাছে সায়ন্তন আর পাঞ্চালী। দই কোপ্তা, ছবি, খাওয়াদাওয়া সবই হল- সায়ন্তনরা যখন অফিস ফিরল, দেখলাম ওদের চূড়ান্ত পেশাদারি বৃত্তে কখন ছিদ্র করে ঢুকে পড়েছে পিসিমণি। হয়ে গেছে পিসিমা। একেবারে কাছের মানুষ। এমনটাই অবশ্য দেখে এসেছি আজবীন। কত অজানা, অচেনা মানুষের কাকিমা, মাসিমা, পিসিমা হয়ে গেছে অনায়াসে। সত্যি এমন মা আর কে আছে। আর পিসিমণির এই মা হওয়ার রেসিপিটা বোধহয় আমি জানতাম। একটু উষ্ণতা, অনেকটা আন্তরিকতা আর বুকভরা ভালবাসা।
সারাজীবন অকাতরে এই ভালবাসা বিলিয়ে গেল একটা মানুষ। অসাধারণ জীবন। আমাদের আত্মীয়স্বজন, চেনা পরিজনদের উৎসবে-পার্বণে, শোকে-সন্তাপে সবার আগে পিসিমণিকে দেখতাম। হেঁশেল সামলাচ্ছে। গোটা পরিবারকে আগলে রেখেছে বুকের আড়ালে। আর এটা শুধু চেনা মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কত অচেনা মানুষ, অজানা পরিবার তাঁর এই ছায়া পেয়েছে। মানুষ বিপদে পড়লেই হল, পিসিমণি চলল। কখনও কোনও মুমূর্ষর সেবা করেছে নিজের হাতে, কখনও কোনও স্বজনহারা পরিবারে রান্নাঘর সামলে তাদের খাওয়াদাওয়ার দেখভাল করছে, আবার কোনও বাড়ির পুজোয় প্রসাদের আয়োজন থেকে ভোগ রান্না- সবটাই করছে নিজের হাতে। অদ্ভুত একটা লিডারশিপ, অদ্ভুত তাঁর দাপট, অসম্ভব সম্মোহনী ক্ষমতা- যার আকর্ষণে সবাই ছুটে গেছে তাঁর দিকে, সেও কোনও কিছু না ভেবে, কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে পিসিমণিও ছুটে গেছে মানুষের দিকে। লাল পাড়ের সাদা শাড়িটায় আমি যেন কোথাও অদৃশ্য নীল রঙ দেখতাম। সেবার রঙ। মাদার টেরিজার মতো। আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত প্রতিমা।
ভোগ রান্নায় মনে পড়ল। একটা দীর্ঘ সময় কলকাতার বুকে আমাদের সঞ্জীবনী ছিল পিসিমণির হাতের রান্না করা নারায়ণের ভোগ বাড়িতেই ছিল শালগ্রাম শিলা। সেই ‘নারায়ণদাদা’কে নিজে হাতে রোজ ভোগ বেঁধে দিত পিসিমণি। আমরা তখন মফস্সল থেকে কলকাতায় আসছি ভবিষ্যতের খোঁজ। খিদে পেলেই পিসিমণির কাছে। আর শুধু আমি কেন, আমাদের আত্মীয়স্বজনকুল, পিসিমণির নিজস্ব ভক্তকুল সবার একটাই ধারণা ছিল, দক্ষিণ কলকাতার পার্ক সাইড রোডের ওই বাড়িটায় গেলে খাবারের কোনও অভাব হবে না। কিছু না কিছু হাতে নিয়ে পিসিমণি হাজির হবেই। আর আপনাকে খেতেও হবে। শূন্য মুখে কিছুতেই ওই বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না। যখন অসুস্থ, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না কোনওভাবে, তখনও কোনওরকমে ফ্রিজ অবধি গিয়ে ডিশে করে সাজিয়ে আনছে কিছু না কিছু। অতিথি তাঁর কাছে নারায়ণের মতোই, যাঁকে আরাধ্য মেনে এল সারাজীবন। পিসিমণির শূন্য খাটটায় বসে স্মৃতিচারণ করছিল বড়দিদি, পিসিমণির বড় মেয়ে। ‘এরকমই কেউ এসে একদিন বলল, আজ কিছু খাব না। অম্বল হয়েছে। মা একটা জেলুসিল নিয়ে হাজির। খালি মুখে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া যাবে না!’ ওই বাড়ির এই কয়েকদিনের জমাট শূন্যতা, নির্জনতাকে ভেঙে হেসে উঠি আমরা। অনেকদিন পর। অথচ তাঁর থাকার সময় চারপাশটা যেন গমগম করত। পাড়ার কারও বাড়িতে হাঁড়ি চাপেনি। কীভাবে খোঁজ চলে আসত পিসিমণির কাছে। তারপর দেখতাম, বাটির পর বাটি চালান হয়ে যাচ্ছে তাদের বাড়িতে। রীতিমতো ধমক টমক তাদের ডেকে নিয়ে আসছে বাড়িতে। তারপর হাত ভর্তি তরিতরকারি দিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছে। এরকম কত। একটা গোটা জীবনে শুধু এভাবেই অন্যের রান্নাঘর ভরে দিয়ে গেল একটা মানুষ। তাঁর নিজেরও সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। অবসরপ্রাপ্ত স্বামী। বিবাহিত কন্যারা। অথচ নিজে বেঁচে থাকল অন্যের অন্নপূর্ণা হয়ে। নিজের ভাঁড়ারেও কোনওদিন কম পড়ল না। আসলে মানুষ সম্পর্কে প্রবল আকর্ষণ, প্রবল মানবতাবোধ বোধহয় সব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দিতে পারে। পিসিমণির জীবনটাই একটা বড় প্রমাণ।
দিদি বলছিল, ‘মা দেখলাম ঘুগনির সঙ্গে পাউরুটি টুকরো, টমেটো, ধনেপাতা, লঙ্কা মিশিয়ে তাওয়ায় সেঁকে টিকিয়া বানিয়ে নিল। চায়ের সঙ্গে সেটাই পরিবেশন করে দিল। এরকম কত। কোথা থেকে কী তৈরি হত, আমরা নিজেরাও বুঝতে পারতাম না। রীতিমতো রহস্যময় রান্নাঘর।’ আমার নিজের স্মৃতিতে টাটকা এখনও পিসিমণির হাতের পোলাও। নারায়ণের ভোগ। ফ্রিজ বোঝাই থাকত। কখন কে এসে যায়, পিসিমণি তো না খাইয়ে তাকে ছাড়বে না। দারচিনি, জায়ফল এসব মিশিয়ে নিজের আবিষ্কার করা স্পেশাল পোলাও মশলাও রেডি থাকত। পোলাও কম পড়লে আবার হাঁড়ি চাপত। লোকজনের আনাগোনার তো শেষ নেই। প্রতিদিনই যে ওই বাড়িতে কোনও একটা পুজো কিংবা নতুন কোনও উৎসব।