পয়লা বৈশাখের হ্যাংলামি
উফ, এই চৈত্রর শেষে সুয্যিমামা যা টেম্পার নিচ্ছে, ভাবা যাচ্ছে না। পারদ এক্কেবারে উর্দ্ধমুখী। সানগ্লাস, ছাতা কোনওকিছুতেই যেন সিচুয়েশনটা ট্যাকেল করা যাচ্ছে না। ঘর থেকে বাইরে বেরোলেই ‘ব্রাইটনেস’ এত বেড়ে যাচ্ছে যে চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। তাও কি রেহাই আছে? প্রাইভেট সেক্টরে তো আর কোনও সামার ভ্যাকেশন থাকে না। অগত্যা, রোজ গরমে ঘেমে-নেয়ে, বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে আপিস-যাত্রা। সব মধ্যবিত্ত বাঙালির এক চব্য। আর হ্যাঁ, আমিও এই দলেই পড়ি। তবে আমি আবার ভীষণ রকমের ‘অপটিমিস্ট’। গরম-ফরমকে বিন্দাস নক করে আড়াই খানা জামা বাগিয়ে ফেলেছি। আরে, কাল তো পয়লা বৈশাখ। গরম বলে বাংলা বছর শুরুর এই দিনটাকে ভুলে যেতে হবে? হারগিজ না।
বাবা ব্যবসায়ী। এই দিনটায় বরাবর দেখছি দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় একগাদা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাবা ঢুকত। প্যাকেটের পর প্যাকেট খুলে বেরোচ্ছে গোলাপি-সবুজ রঙের কড়া স্বাদের মিষ্টি, সঙ্গে লাড্ডু, সোনপাপড়ি আর তেকোণা নিমকি। এত্তো মিষ্টি যে শেষ হতে হতে তিন-চারদিন লেগে যেত। আর ছিল হালখাতা। যেতাম বাবার সঙ্গে, মিষ্টির লোভে খানিকটা তো বটেই কেউ কেউ কোল্ডড্রিঙ্কও খাওয়াতো। বাড়ি ফেরার পথে কাকুগুলো হাতে ধরিয়ে দিত ক্যালেন্ডার। মিষ্টির প্যাকেট এখনও আসে। তবে এখন যেন প্যাকেটের বস্তুগুলোর খানিক বদল হয়েছে। এখন প্যাকেটে যোগ হয় হলদিরামের ঝুড়িভাজা, কেক এমনকি প্যাটিসও। এসব বাদে আমার বা হয়ত আমার মতো অনেকেরই কাছে পয়লা বৈশাখ মানেই ছিল মায়ের হাতের ভাল-মন্দ রান্না, যেগুলো হয়ত কালেভদ্রে বাড়িতে হত। পুরো পরিবারের সকলের সঙ্গে বসে পাত পেড়ে মায়ের হাতের ওই রান্নাগুলোর স্বাদের স্মৃতি আজও অমলিন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পছন্দটা একটু বদলেছে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কাটানোই তখন মূল মন্ত্র। বাড়ি থেকে কিছু একটা নাকে মুখে গুঁজে বন্ধুদের সঙ্গে মিট করা। পরে ‘পাইস’ কোনও হোটেলে বিরিয়ানি নাহলে চিলি চিকেন-ফ্রায়েড রাইস। কম পয়সায় খাওয়ার এই দোকানগুলোর খাবার স্বাদ তখন হেব্বি লাগত। বিশেষ করে চিলি চিকেনের ওই গ্রেভি মাখা পেঁয়াজ-ক্যাপসিকাম…আহ্!!!
‘কি রে? একটু রেস্ট নিবি বলে তো বিন্দাস ঘুমিয়ে পড়লি!’
হঠাৎ অফিসের সিনিয়রের ধাক্কাটায় চিলি চিকেনের পিসটা যেন মুখে ঢোকার আগেই মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
রোদ থেকে অফিসে ঢুকে একটু চোখ বুজতেই চোখের সামনে যত পুরনো পয়লা বৈশাখ স্মৃতি। প্রাক-পয়লা বৈশাখে এহেন হালুসিনেশন ঘটে আর কি! কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গে গালটা একটু ফুলল বটে—
‘দিলে তো চিলি চিকেন মাটিতে ফেলে? একটু পরে ডাকতে পারতে তো! ধুস। যাক বল, কাল তো পয়লা বৈশাখ। নেমন্তন্ন আছে কোথাও?’
‘কোথাও মানে? বল কোথায় কোথায় আছে?’
নাহ, আমরা তো সব হ্যাংলার দল। পয়লা বৈশাখের দিন নানা হোটেল-রেস্তোরাঁয় আদুরে নিমন্ত্রণ থাকে। কিন্তু আপনারা কি করছেন কাল? ভেবে দেখেছেন কোথায় খেতে যাচ্ছেন? না হলে জানিয়ে রাখি কাল কিন্তু শহরের বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয় রয়েছে বৈশাখী ভোজের আয়োজন। দ্য পার্ক, পার্ক প্লাজা, ঝাল ফরেজি, দ্য স্ট্যাডেল, হোটেল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল, গ্র্যান্ড হোটেল, সুইসোতেল, দ্য ললিত গ্রেট ইর্স্টান, দ্য অ্যাস্টর, দ্য সনেট—সব জায়গায় থাকছে বাঙালি ভোজের ব্যবস্থা। নামকরা বাঙালি রেস্তোরাঁ যেমন ফিশফিশ, ৬ বালিগঞ্জ প্লেস, সপ্তপদী, কিউপিজ, সুদীপার রান্নাঘর, ভজহরি মান্না, তেরো পার্বণ, কষে কষা ইত্যাদি জায়গাগুলোয় দারুণ দারুণ সব বাঙালি পদ যে থাকবে সেটা বলাই বাহুল্য। তো পাতে পড়তে পারে কী কী? উমম, বলে রাখি এইসব হোটেল/রেস্তোরাঁয় ভেজ-ননভেজ দু’ধরনের খাবারেরই দেদার আয়োজন থাকে। তাই নিরামিষ-আমিষ মিলিয়ে পাতে পরতে পারে শুক্তো, সোনামুগের ডাল, এঁচোড়ের কালিয়া, পোস্তর বড়া, গাছ পাঁঠার চপ, কচুর লতির কুড়কুড়ে বড়া, তোপসের ফ্রাই, সাদা ভাত, বাসন্তী পোলাও, লুচি, মরিচ মাংস, খাসির মাংস, কাতলা পেটির কালিয়া, ডাব চিংড়ি, চিংড়ির মালাইকারি, নানা রকমের চাটনি, মিষ্টি, দই ইত্যাদি ইত্যাদি। জায়গা বিশেষে মেনু বদলালেও মোটের ওপর এই থাকবে। মানে বেশ কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার মতো মেনু আর কি! তারপর যদি কোথাও থেকে একটা মিঠা পান জোগাড় করা যায় তো কোনও কথা হবে। পয়লা বৈশাখের হ্যাংলামি একেবারে জমে ক্ষীর। শুনুন না আমাদের মা-কাকিমারা তো সারাবছর আমাদের ভালমন্দ রেঁধে-বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। কালকের দিনটা অন্তত ওনাদের রেস্ট হোক। নিজেদের রান্না তো রোজই খান ওনারা। সেই চেনা স্বাদ একটু অচেনাভাবেই নাহয় ধরা দিক ওদের কাছে।
উফফ, লেখার মাঝে আবার কে পিং করল—
ভাই মেসেজ করেছে। বাংলা মায়ের অ্যাংলো ছেলে কাল নাকি পুরো ‘বং ফুড’ খাবে। দায়িত্ব আমার। গেল রে বছরের শুরুতেই গচ্চা যাবে! কি আর করা…ভাই চেয়েছে খাওয়াতে তো হবেই। পরে ঠিক উসুল করে নেব।
ও হ্যাঁ, #হ্যাংলাহেঁশেল-এর পক্ষ থেকে আপনাদের জানাই নতুন বাংলা বছরের অনেক শুভেচ্ছা। নতুন বছর খুব খুব খুব ভাল কাটুক। আর যারা এই রোদে বাইরে না খেয়ে বাড়িতেই লোকজন ডেকেছেন অথচ কী কী রাঁধবেন সেটা ডিসাইড করতে পারেননি তাদের জন্য তো আমাদের ওয়েবসাইট www.hanglamagazine.com থাকলই। যেখানে মিলবে প্রচুর খাবারের সুলুক সন্ধান।