একটু O2
17 May 2021 | Comments 0
অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়-
জি বাংলা কিংবা স্টার জলসার পুরোনো এপিসোডগুলো ছেড়ে বিকেলবেলায় মাকে ছাদে হাঁটতে নিয়ে যাওয়াটা লাদাখ সীমান্তে যুদ্ধের মত ছিল। বিছানা ছেড়ে উঠতেই চাইত না মা। রোজ রাগারাগি। কোনদিন আমি জিততাম, কোনদিন মা। আমি যেদিন জিততাম, বিকেলবেলা ছাদে মাকে হাঁটতে যেতে হত, মা জিতলে টিভি জিন্দাবাদ। সেবার মাঝে মাঝে চাল, ডাল বিলির জন্য বের হতে হচ্ছিল। মাকে তাই আমার ঘরে আসতে দিতাম না। কোথায় কখন কী হয়ে যায়!টাটুম, চইদেরও সে ভারি মজার সময়। সবাই বাড়িতে। মাঝে রান্না করতে ইচ্ছে করছিল। করছিলামও। এক্সট্রাটাইম, টলিটাইম কিংবা হ্যাংলা চলছিল বাড়ি থেকেই। লাইভ স্ট্রিমিং শিখতে হল দ্রুত। বুঝতে পারছিলাম, মিডিয়াটাই বদলে যাচ্ছে দ্রুত। চ্যালেঞ্জ ছিল, আশংকাও ছিল, কিন্তু একটা বিশ্বাস, প্রত্যয়ও ছিল যে এই যুদ্ধটা জিততে হবে, জেতা সম্ভব।একে অপরের পাশে থাকতে রাস্তায় নেমে পড়েছে সবাই। সৌরভ গাঙ্গুলি নিজে রামকৃষ্ণ মিশন কিংবা ইস্কনে গিয়ে চাল বিতরণ করছেন।পাড়ায় পাড়ায় কমিউনিটি কিচেন শুরু হচ্ছে।পুলিশ পাড়ায় এসে গান গেয়ে বলছে, ঘরে থাকুন। থালা বাজানো, মোমবাতি জ্বালানো চলছে। তাই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কাটছিল বেশ। কেউ ডালগোনা কফি বানাচ্ছেন, কেউ আবার মিষ্টির দোকানের ইমিউনিটি সন্দেশটা খাওয়া হলনা বলে আপশোষ করছেন।মোবাইলে লকডাউন কিংবা বাড়িতে থাকার নতুন অভ্যেস নিয়ে কত লেখা, কত মজা, কত মজার ভিডিও। ফেসবুক জুড়ে রান্নার ভিডিও, পুরোনো আলমারি থেকে হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা কিংবা হলুদ হয়ে যাওয়া কবিতার বই উদ্ধার। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমে অভ্যস্থ হচ্ছিল জীবন। প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলাম রনিদার চলে যাওয়ায়। আজকালের চিত্রসাংবাদিক রনিদা ছিল প্রাণের মানুষ। শুধু আমার নয়, আমার মত অনেকের। শরীর খারাপ ছিল কয়েকদিনই, কিন্তু বাঙ্গুর হাসপাতাল অবধি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই রনিদা মাঠ ছেড়ে উঠে গেল।হয়ত কোথাও ফেরার তাড়া ছিল।সাহস হারাইনি তারপরও।তারপরও তো বেড়িয়ে পড়েছি ক্যামেরা টিম নিয়ে।শুট্যিং সেরেছি, যাদবপুরের কমিউনিটি কিচেন থেকে সৌরভ গাঙ্গুলিকে নিয়ে বিজ্ঞাপন।প্রথম পর্বে করোনা চলে যাবার আগে অবশ্য আমার নিজের পরিবারই নাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।পুজোতে পুরোনো বাড়ি দক্ষিণেশ্বর গেলাম। মাকে নিয়ে। আমি আর দাদা। পুজোর পরই দক্ষিণেশ্বরের গোটা বাড়িটা ছিল কোভিড পজেটিভ।কাকা, কাকিমারা সবাই।মা,দাদা,বোন- দাদা হাসপাতালে ভর্তি হল। এক কাকা মারা গেলেন। মা অ্যাসিম্পটোমেটিক।গোটা বাড়ি সামলাচ্ছি আমরা তিন ভাই,ভাইদের স্ত্রীরা আর বোনের ছেলে।সামলেও উঠলাম।দাদা বাড়ি ফিরল।মা আপাত সুস্থ।কিন্তু ভিতর ভিতর যে শরীরে ঘূন ধরেছে কী করে জানব।করোনা তাই করোনা প্রথমবার যাবার আগে মাকে সঙ্গে নিয়েই গেল।
সময় ভুলিয়ে দেয় অনেককিছু। শূণ্যতা ভরে না, কিন্তু ভুলতে হয়।মাঝের তিন চারটে মাস সেই ভোলার পরীক্ষা। সেকেন্ড ওয়েভ আসছে, খবর আসছিল। কিন্তু আমরা সবাই তখন ভোটে ভুলে।তারই মাঝে ঘুম থেকে উঠে একদিন দেখি, অরিজিতের চারটে মিসড কল।অত সকালে অরিজিত!একটু অবাক হয়েই ফোন ব্যাক করলাম। ফোন ধরছে না। ওর স্ত্রী কোয়েলকে পেলাম, কোনরকমে ফোন ধরে বলল, “দাদাভাই মাকে নিয়ে বহরমপুর হাসপাতালে যাচ্ছি।পরে ফোন করছি।“ পরে ফোন এল, কাকীমা কোভিড পজেটিভ।প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে বহরমপুর মাতৃসদনে ভর্তি।পরের কয়েকদিন কলকাতায় ডাক্তার, বেড, টোসিলিজুম্যাব,একমো সবকিছু নিয়ে বিস্তর ফোনাফুনি, যোগাযোগ।কাকিমাকে কলকাতায় আনা হল। ঢাকুরিয়া আমরিতে থাকাকালীন আবার ব্রেন স্ট্রোক।অপারেশন হল।দাঁতে দাঁত দিয়ে কলকাতার হাসপাতালে লড়ছেন এক রত্নগর্ভা মা।আর তেমন তাঁর ছেলে। যে ছেলে মাকে নিয়ে গান গাইতে হলে ভরা কনসার্টে চোখের জল ফেলে, সে এখন সব কষ্ট, যন্ত্রনা লুকিয়ে লড়ছে। না শুধু নিজের মা এর জন্য নয়।রাতে হাসপাতালে মায়ের জন্য রাত জাগে, আর দিনে হাজারো মানুষের জন্য বেড, অক্সিজেন যোগাড় করে বেড়ায়। কাউকে কনসেনট্রেটর কিনে দেয়, কাউকে সিলিন্ডার। সেদিন রাতে হাসপাতাল থেকে ভিডিও কল করল।চোয়াল শক্ত,”এই লড়াইতে জিততে হবে কিন্তু।আমি শেষ অবধি লড়ব অনিলাভদা।“ আপাতত স্বপ্ন বহরমপুর আর কলকাতায় আরও আইসিইউ ইউনিট বাড়ানোর।বাচ্চাদের জন্য ওয়ার্ড তৈরি রাখা।নিজে অর্থ সংগ্রহ করে, দরকারে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে।
অদ্ভূত একটা সময় দেখলাম গত কয়েকদিন।কিছু মানুষ যথারীতি মুনাফা লুটতে নেমে পড়েছেন।কিছু মানুষ সব দূর্ভোগ অসহায়ের মত সহ্য করছেন। আর একদল মানুষ লড়ছেন। নাগরিক সমাজের এই দাঁত চেপে লড়াইটা দীর্ঘদিন মনেও থাকবে। সভ্যতার পিলসুজ হয়ে আসলে দাঁড়িয়ে আছেন এরাই। সাধারণ মানুষ।অভিষেক ডালমিয়ার একটা পোস্ট দেখছিলাম কিছুদিন আগে।Someone needs oxygen. Someone messages someone. Someone reads the message. Someone amplifies the message. Someone forwards a contact. Someone verify the contact…..All because of Someone’s will to help Someone. So many Someone have come forward to serve humanity in this tough time….Thank you Someone from Someone…..কোভিড নিয়ে এই লড়াই,মানব সভ্যতার এই পর্বটা সবচেয়ে ভালো বোধহয় এই কয়েকটা শব্দে ধরা আছে।অনেক অমানবিক গল্প হয়ত ইতিউতি উড়ে আসে, কিন্তু মানবতার যে সুনামি দেখছি চারপাশে, তাতে উড়ে যাচ্ছে বাকিটা।পরমব্রত,অনুপম রায়রা আইসোলেশন সেন্টার খুলছেন শুনে ফোন করলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। “ওদের সেন্টারে কয়েকটা কনসেন্ট্রেটার দিতে চাই। যোগাযোগ করিয়ে দাও।“ সৌরভ গাঙ্গুলির নিজের অফিসও এই মূহুর্তে রীতিমত কলসেন্টার।হাসপাতালের বেড থেকে নানা যোগাযোগ, সামলাচ্ছে তাঁর টিমমেম্বার তানিয়া।প্রায় ৫০ টা অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটার পৌঁছে গেছে কলকাতার নানা প্রান্তে।কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বে বন্ধু সঞ্জয়।‘চেলা’ শতদ্রু জিন্দাল আর সৌরভ গাঙ্গুলি ফাউন্ডেশনের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে জেলায় জেলায়।এই কয়েকদিন অতন্দ্র প্রহরীর মত রাত জাগছেন সৃজিত, স্বস্তিকারা।অক্সিজেন নেই, বেড নেই, রক্ত চাই। কখনও ট্যুইট, কখনও ফেসবুক পৌঁছে দিচ্ছেন আরও মানুষের কাছে।গায়ক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের বাবার অসুস্থতা শুনে সিলিন্ডার নিয়ে হাজির পরিচালক শিবপ্রসাদ আর স্ত্রী জিনিয়া।নিজের রেস্তোরাঁ থেকে দেব খাবার দিচ্ছেন তো কমিউনিটি কিচেন করছেন অঙ্কুশ, বিক্রম,ঐন্দ্রিলারা।পাড়ায় পাড়ায় খাবার বিলি করতে চলেছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। কে বলে সোনু সুদরা শুধু মুম্বইয়েই থাকেন!এক বুক মানবতা নিয়ে কলকাতা কিন্তু পিছিয়ে থাকে না। এরা তো তবু সেলিব্রেটেড মানুষজন।পরিচিতি, যোগাযোগ, অর্থবল, পাশে থাকার মানুষ সবটাই বেশি।কিন্তু সাধারণ মানুষ।পুবের আকাশে লাল সূর্য দেখা রেড ভলেন্টিয়াররা, পাড়ায় পাড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিলি করা ক্লাব, ফ্রিতে খাবার বিলি করা রেস্তোরাঁ, তাঁদের কী বলবেন!পরিচিত একজনের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিতে গেলাম যাদবপুরে আদর্শ সংহতি ক্লাবে।দেখে এলাম, কী অসাধারণ শৃঙ্খলায় একের পর এক সিলিন্ডার তারা পৌঁছে দিচ্ছেন একের পর এক জায়গায়।এক বন্ধু কোভিড আক্রান্ত তাঁর দাদার পরিবারের জন্য কীভাবে খাবার আয়োজন করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। হ্যাংলা টিমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হল, স্থানীয় খোয়াব রেস্তোরাঁর প্রতিমা বসুর সঙ্গে।তিনি বললেন, আমি দেব। নিয়মিত খাবার পৌঁছে যেত অই বন্ধুর দাদার বাড়ি।এরকম কত গল্প। প্রতিদিন দেখি, খবর পাই, বহু রেস্তোরাঁ এভাবেই ফ্রিতে খাবার পৌঁছে দিতে চাইছেন কোভিড আক্রান্ত পরিবারগুলোর কাছে। এ এক অদ্ভূত মানব শৃঙ্খল, সংকটের এই সময়ে যেন একে অপরের হৃদয় ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে।কত মানুষ লড়ে যাচ্ছেন একা একাই।যে যেখানে যতটুকু পারেন, কলকাতার এই মুখ আমি অন্তত আগে দেখিনি।সবাই মিলে একজোট এবার।ওঙ্কারনাথ মিশনের প্রেসিডেন্ট প্রিয়নাথ সেদিন তাঁদের হরিদেবপুরের সেফ হোম দেখতে নিয়ে গেছিলেন।দুদিন আগে ফোন করে জানালেন, আমাদের ডানলপের মূল মন্দির মহামিলন মঠও আমরা সেফ হোমের জন্য খুলে দিচ্ছি।হজ হাউস আগেই সেফ হোমের জন্য অনুমতি দিয়েছিল রাজ্য সরকারকে।আমার এক পরিচিত প্রাক্তন সিনিয়র কলিগ থেকেও এলেন সেখানে। জানালেন, ভালো আয়োজন। শুনলাম, এবার সেটা হাসপাতাল হচ্ছে।কিংবা বেহালা গুরুদ্বার।আজই গেছিলাম।ওরা খুলেছেন অক্সিজেন লঙ্গর।বিনা পয়সায় যাতে মানুষ প্রাণভরে অক্সিজেন নিতে পারেন এই দমবন্ধ সময়ে, সেই ব্যবস্থা করছেন ওরা।কী অসাধারণ মানুষ নেপথ্যের লোকটা, সতনাম সিং আলুওয়ালিয়া।আলাপ হয়েছিল গতবছর লকডাউনের সময়।তখন মানুষকে খাওয়াচ্ছিলেন। এবার অক্সিজেন দিচ্ছেন।কোভিড আক্রান্ত মানুষজন আসছেন। চেয়ারে বসে অক্সিজেন নিয়ে SPO2 কাউন্ট বাড়িয়ে ফিরছেন।অসুস্থ মানুষজন, তাঁদের পরিবারের সবার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও তাঁদের।সতনামজী আর তাঁর ভাগ্নে চিরাগ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবটার তদারকি করছেন। কোভিড রোগীদের মাঝে। ভয় করছে না?মনে দাগ কেটে দেবার মত উত্তর দিলেন। “জানেন, আমি নিজেকে বোঝাই, এই বিপর্যয়ে বাড়িতে বসে এর ওর মৃত্যুসংবাদ শুনে আপশোষ করার চেয়ে যেন আমি মানুষের কাজ করতে গিয়ে যেন চিরবিদায় নিতে পারি!” সত্যি কতজন এরকম বলতেও পারেন!
সত্যিই প্রতিটা দিন যাচ্ছে, আর আপশোষটাও বাড়ছে। কত কত মানুষ রোজ চলে যাচ্ছেন। কত চেনা মানুষ,কত তরতাজা জীবন।ব্যান্ডেলে আমাদের বেড়ে ওঠার রেল কোয়ার্টাসে রবিবার একটা স্কুল চলত।এক বন্ধুদের কোয়ার্টা্রের বারান্দায়। ব্ল্যাকবোর্ড থাকত, চক থাকত, থাকত ডাস্টার।এমনকি রোলকলের খাতাও।স্কুলের দুই মাস্টারমশাই। বেনুদা আর টুকাইদা।বেনুদারা তখন ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর, আর আমরা সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি।অন্যদিন বিকেলে বেনু মাস্টার, টুকাই মাস্টাররা আমাদের খেলার পার্টনার। গোলকিপার খেলত বেনুদা।আর রোববার হলেই মাস্টার।ওটাই যেন খেলা, স্কুল স্কুল খেলা।সেদিন শুনলাম আমাদের সেই বেনুমাস্টারের নিজের অ্যাটেনডেন্স লিস্ট থেকে চিরকালীন অনুপস্থিত এন্ট্রি হয়ে গেল। একই দিনে আমার আরেক টিচারের ছেলে। কতই বা বয়েস তার? বড়জোর ত্রিশ, বত্রিশ? এগুলো চলে যাবার বয়েস!আজকালে আমাদের সহকর্মী বাসুরাজ মালিক শুনলাম চলে গেলেন।প্রতিবার বইমেলায় আজকালের স্টলে গোটা টিমটাকে যেন লিড করতেন বাসুদা।ফেসবুকেই তাঁর স্মৃতিচারণে দেখলাম শৌনকদা লিখেছেন। শৌনক লাহিড়ি। আজকালের সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান।কী হইহই করা উপস্থিতি ছিল শৌনকদার। কয়েকদিন পর শুনলাম, শৌনকদাও নেই।এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন সুমনের খবরটাও এল। সুমন ছিল আমাদের ‘এগারো’ সিনেমার সহকারী পরিচালক। ঝকঝকে ছেলে।ফেসবুকে ওর সঙ্গে কথা হয়েছে দেখলাম,এই ৩মে। লিখেছিল, “আমি হাসপাতালে ভর্তি। তুমি আমার স্ত্রীর জন্য একটা সিলিন্ডার অ্যারেঞ্জ করে দিতে পারবে?” ব্যবস্থা হল।ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বের হবার সময় আবার মেসেজ করল, “থাক এখন লাগছে না।ওরা লোকালি অ্যারেঞ্জ করে নিয়েছে।“ মেসেজগুলোয় দেখলাম,শেষে থ্যাঙ্ক ইউ বলেছিল সুমন। আমি বলেছিলাম, তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। আর আজ ১৬ মে শুনলাম, সুমনও নাকি চলে গেল।না, ভালো লাগছে না। একেবারে ভালো লাগছে না। প্রথম পর্বটা কেড়ে নিয়েছিল আমাদের সৌমিত্রকে, এবার গেলেন শঙ্খবাবু।বাঙ্গালির এই বিবেকরা চলে যাবার সঙ্গে ভাল থাকার দায়িত্ব নেওয়া মানুষরাও চলে যাচ্ছেন ‘চুপিচুপি, একা একা’। ডাঃস্মরজিত জানা চলে গেলেন।ব্রজ রায়ও। সমাজে কী কন্ট্রিবিউশন এই লোকগুলোর! এইভাবে চলে যাবেন! না, এই মৃত্যু মিছিল আর মেনে যাওয়া যাচ্ছে না!
মেনে যাওয়া যাচ্ছে না এই প্রতিদিন একটা বেড, আর একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য হাহাকারটাও। একটা সভ্য দেশে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন পাবে না, হয় নাকি!’লাইফ ইন এ মেট্রো’ সিনেমার ওই দৃশ্যটা মনে আছে!যানজটে আটকে ধর্মেন্দ্রর অ্যাম্বুলেন্স।ভিতরে অক্সিজেনের জন্য ছটফট করছেন নাফিসা আলি।পরিচালক অনুরাগ বসু আমাকে বলেছিলেন, “আসলে ওটা আমার জীবনের ঘটনা।আমাকে যখন টাটা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন খুব খারাপ অবস্থা আমার।অক্সিজেন নিতে পারছি না।আর আমার অ্যাম্বুলেন্সটা আটকে যায় ট্রাফিক জ্যামে।মনে হচ্ছিল, আর বোধহয় হাসপাতাল অবধি পৌঁছাতে পারব না।“ ভাবুন এভাবে প্রতিদিন কত মানুষ একটু প্রাণবায়ু নেওয়ার জন্য কলকাতার এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল অবধি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।এটা লজ্জা নয়? তাহলে কোনটা লজ্জা!!আমার বাবা যখন জীবনের শেষ পর্বে লড়ছেন, ডাক্তার আশা ছেড়ে দেওয়ায় বাড়ি নিয়ে এসেছি, একরাতে হঠাত দেখলাম, স্যাচুরেশন নামছে।বেড়িয়ে পড়লাম ট্যাক্সি নিয়ে।না সে রাতে গোটা মধ্য আর দক্ষিন কলকাতা তন্নতন্ন করে খুঁজেও অক্সিজেন পাইনি। তাই রোগটা পুরোনো এই শহরের।লজ্জাটাও পুরোনো।বাবা সে রাতে সামলে নিয়েছিল।পরে যেদিন পারল না অক্সিজেন সত্ত্বেও, সেদিন বিশ্বাস করুন, পালস অক্সিমিটারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।আর কাউন্টটা সব কান্না, আকুতি,হাহাকারকে জাস্ট ডোন্ট কেয়ার করে ক্রমশ কমতে থাকে, ৭০…৬০…৫০…৪০…২০…… আর এই উলটো গুনতিটা যেন নিয়ম হয়ে গেল এই শহর, এই রাজ্য, এই দেশের! কী দূর্ভাগ্য!
গ্রেমাইন্ডে কমিউনিকেশনে, আমাদের অফিসের ছেলে মেয়েরা মোটামুটি জেনে গেছে, এরকম সময়ে বস কিছু একটা পাগলামি করবে, আর ওদের তাতে সাথও দিতে হবে। সেদিন কনকল হল বাড়ি থেকেই। কী করা যায়!প্রস্তাব এল, অক্সিজেন পার্লার হতে পারে। আমি বললাম, “দাঁড়াও কল্লোলদাকে কনকলে অ্যাড করি, আমি শুনেছিলাম কল্লোলদাও এরকম কিছু করতে চাইছে।ওর কী অভিজ্ঞতা শুনে নেওয়া যাক।“ কল্লোলদা হলেন কল্লোল ঘোষ। সমাজসেবী।গোবিন্দপুরে ওর সংগঠন ‘অফার’ প্রায় শ’দুয়েক এইচআইভি অনাথ বাচ্চাকে মাথার ছাদ দেয়।কল্লোলদা শুনে বললেন, তাহলে এক সঙ্গেই কিছু করি, চলো না! কিন্তু এসব কিছু করার জন্য তো কিছু মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ্রর পরামর্শ চাই। গেলাম ডাঃ শুভঙ্কর হোমের কাছে। শিয়ালদহে বি আর সিং হাসপাতালের সঙ্গে জড়িয়ে ডাঃ হোম।মানুষ ভালবাসেন।তিনি শুনে ফোন করলেন তাঁর বাল্যবন্ধু ডঃ সুবর্ণ বোসকে।আই আই এইচ এমের কর্ণধার ডঃ বোস এই শহরের কিংবদন্তী বাঙালি উদ্যোগপতি।তিনি ফোন করলেন হিডকোর দেবাশিস সেনকে। সেই অভিষেক ডালমিয়ার ওয়ালে পড়া শব্দগুলো, সামওয়ান টু সামওয়ান। দেবাশিসবাবু নিজে গাড়িতে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন আমাদের। নিউটাউনে একটা পাম্পিং স্টেশনের পাশে হিডকোর একটা দোতলা বাড়ি। গতবার তাঁরা সেফ হোম করেছিলেন।এবার আমাদের দিতে পারেন। রাজি হয়ে গেলাম।এখানেই এই শহরের কিছু মানুষকে অক্সিজেন দিতে চাই আমরা।একটা ফোন করে এলেই হবে, আর ২৫ টা বেডের কোন একটা ফাঁকা থাকলেই হবে।সম্পূর্ন বিনামূল্যে তাঁকে অক্সিজেনের সাময়িক একটা ব্যবস্থা করে দেব আমরা।অসুস্থ রোগীকে নিয়ে ঘুরতে হবে না কলকাতার এক প্রান্ত থকে অন্য প্রান্তে।রোগী অক্সিজেন পাবে, তাঁর মধ্যে পেশেন্ট পার্টি কিছুটা সময় পাবে কোন একটা হাসপাতালে অ্যাডমিশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে নেওয়ার।আপাতত আমাদের প্রস্তুতির পালা।নিজের হোটেল থেকে আইসোলেশন সেন্টার সাজিয়ে দিচ্ছেন সুবর্নদা।আর চলছে প্রতিদিনই কনকল কিংবা জুম কল।সঙ্গী হয়েছেন নিউটাউন ফোরাম আর নিউজের সদস্যরা।সমরেশরা ওই এলাকায় নানা প্রয়োজনে নিয়ে রীতিমত মুস্কিল আসান। আইসোলেশন সেন্টারের খুটিনাটি দেখার দায়িত্ব নিয়ে নিলেন শাশ্বতী হোম।হাতে রীতিমত ডায়েরি আর পেন নিয়েই ঘুরছেন আর নোট করছেন।মেইল পাঠাচ্ছেন দেশে, বিদেশে। এই সেন্টার চালাতে অনেক অর্থও যে চাই। এভাবেই সবাই রীতিমত পাওয়ার প্লে স্টাইলে খেলা শুরু করে দিয়েছেন। ওই যে কবে ‘তিনি’ লিখে গেছিলেন, “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।“ সৌরভ গাঙ্গুলিকে জানালাম। তিনি দুটো কনসেনট্রেটর পাঠিয়ে দিলেন।সৌরভের মাধ্যমেই মুম্বইয়ে একবার আলাপ হয়েছিল অভীকের সঙ্গে।মাই ইলেভেন সার্কেল নামের যে গেমিং অ্যাপ সৌরভ এনডোর্স করেন, অভীক সেই কোম্পানির উচ্চপদস্থ আধিকারিক। ও শুনেই পাঠিয়ে দিল ১০টা কনসেন্ট্রেটর কেনার টাকা। আরও এদিক ওদিক বন্ধুদের ফোন করে যাচ্ছে,যদি কিছু রানিং কস্ট তুলে দিতে পারে আমাদের।আজই যোগাযোগ করিয়ে দিল রুরাল হেলথ ফাউন্ডেশনের অনন্ত নেওটিয়ার সঙ্গে।তিনি বললেন, এগিয়ে যান।যে কোন প্রয়োজনে সঙ্গে আছি। অরিজিত সিং প্রথম থেকেই গোটা প্ল্যানিংটার সঙ্গে জড়িয়ে।ও থাকছে নানাভাবে। আমরা এভাবেই তৈরি। হয়ত এই মঙ্গলবার, কিংবা বুধবারের মধ্যে বেশ মানুষকে অক্সিজেন দিতে পারব আমরা।কিন্তু তারপরও বহু কাজ পরে। আবার একটা লকডাউন।আর এবারের সঙ্গে পরতে পরতে ভয় জড়িয়ে, অনিশ্চয়তা জড়িয়ে। আর ডালগোনা কফি বানানোর কথা মাথায় আসছে না কারও, হোয়াটসঅ্যাপে আসা মিম কম, সবাই ওই অজানা আতঙ্কে! কী হবে!আমরা কেউ জানি না, কী হবে! লকডাউনটা খুব দরকার ছিল, হয়ত আরও দশ দিন আগেই।মানুষ কী খাবে? সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।কারণ বেঘোরে মারা যাচ্ছে মানুষ। আগে বাঁচুক সবাই।সরকার না করলে আবার মানুষকেই করতে হবে।
কলকাতার এক নামী হাসপাতালের সামনের দৃশ্যটা বলছিলেন আমার এক বন্ধু।অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে শুয়ে মা।বেড পাওয়া যায়নি।বুকের মধ্যে প্রায় উঠে বসে এলোপাথারি পাম্প করছে ছেলে।যদি মায়ের হৃদযন্ত্র আবার চালু হয়ে যায়।হয়নি। নিজের কথা মনে পড়ছিল। ওভাবেই বাবার বুকে পাম্প করছিলাম। লাভ হয়নি।স্যাচুরেশন কমেই যাচ্ছিল ক্রমাগত।একসময় স্থির হয়ে গেল সবটা।মায়ের শেষটা দেখতে পাইনি। বাড়ি ফিরে জেনেছিলাম, কোভিড আসলে মায়ের ভিতরটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।আধঘন্টাও যুঝতে পারেনি।
যদি একটা মাকে, কিংবা একটা বাবাকেও এবার বাঁচাতে পারি। যদি একটা বেনু মাস্টার, একটা বাসুদা, একটা সুমন, একটা শৌনকদাকে এবার সঠিক সময়ে অক্সিজেন দিতে পারি, ফিরিয়ে দিতে পারি জীবনে, সেটাই পরম পাওয়া হয়ে যাবে।
আর সেটুকুর জন্যই সবকিছু, বিশ্বাস করুন।