বহড়ুর কথা এর আগেও হ্যাংলার পাতায় লিখেছি আমরা। জয়নগরের যে মোয়া বাঙালির শীত উৎসবকে সম্পূর্ণতা দেয়, তার এপিসেন্টার আসলে বহড়ু। জয়নগরের ঠিক আগের স্টেশন। কুটির শিল্পের মতো মোয়া তৈরি হয় বাড়িতে বাড়িতে। আর বসে গুড়ের হাট। ভোরবেলা স্থানীয় শিউলিরা খেজুর গাছ থেকে রস নামিয়ে সারাদিন ধরে গুড় তৈরি করে। সেই গুড় আসে বাজারে। বাজার শুরু হয় রাত তিনটেয়। সহকর্মী অলোকেশ থাকে দক্ষিণ বারাসতে। ওর মুখেই শুনলাম এই গুড় বাজারের কথা। শীতকালে প্রতি সপ্তাহের সোম আর শুক্রবার চলে খেজুর গুড়ের এই কেনাবেচা। শোনামাত্রই কোনও এক মাঝরাতে আমাদের ডেস্টিনেশন বহড়ু। আমাদের মানে, সহকর্মী শেফ দেবাশিস আর চন্দন। বহড়ুর গুড়ের হাটে পৌঁছালাম যখন রাত তিনটে। ইতিমধ্যেই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ভ্যানে গুড়ের কলসি চাপিয়ে পৌঁছে গেছেন সেখানে। চলছে কেনাবেচা। বারুইপুর, সোনারপুর, এমনকি কলকাতা থেকেও বেশ কিছু মিষ্টি ব্যবসায়ী পৌঁছে গেছেন সেখানে। গুড়ে হাত ডুবিয়ে শুঁকে নিচ্ছেন গন্ধ। তারপর হচ্ছে বায়না। সইদুল নস্কর, সুলেমান নস্করের সঙ্গে ওখানেই আলাপ হল। চায়ের দোকানে। বহড়ু বাজারের চায়ের দোকান সারারাত খোলা। গুড়ের হাটের ক্রেতা-বিক্রেতারা শীতের রাতে এখানেই ভিড় জমান একটু উষ্ণতার জন্য। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই সব হাঁড়ি চলে যায় নিজের নিজের গন্তব্যে। তারপরের সময়টা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে একটু আড্ডা, আলোচনার। এরা সবাই পেশায় শিউলি। খেজুর গাছ কেটে হাঁড়ি ঝুলিয়ে ভোরবেলা নিয়ে আসে রস। এই রস পৌঁছে দেয় গুড়ের কারখানাগুলোয়। কিংবা নিজেরাই আগুন জ্বালিয়ে রস জ্বাল দেয়, তৈরি করে গুড়। তবে প্রত্যেকেই শঙ্কিত নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যেভাবে খেজুর রসে চিনি দিয়ে গুড় তৈরি হচ্ছে, এবং কমিয়ে ফেলা হচ্ছে দাম, তাতে বহড়ুর শিউলিরা আগামীদিন নিয়ে সত্যিই খুব চিন্তায়। সুলেমানরা বলেছেন, চিনি দিয়ে গুড় তৈরি অনেক সহজ প্রক্রিয়া। খেজুর রসে চিনি মিশিয়ে দিলে গুড় তৈরিও হবে অনেক তাড়াতাড়ি, খেজুর গুড়ের সোনালি তেলের রঙটাও আসবে তাড়াতাড়ি আর দামেও হবে সস্তা। কিন্তু ক্রমশই পড়তির দিকে হওয়ায় শেষ অবধি মার খাচ্ছে গোটা শিল্পটাই। আসল নলেন গুড়ের ঝক্কি অনেক। জ্বাল দেওয়ার সময় লাগে অনেক বেশি, খেজুর রসও লাগে বেশি। এই সময়ের ব্যবসায়ীরা কেউ এই ঝক্কিটা নাকি নিতে চাইছেন না। সস্তার উপায় হল, চিনি। রসে চিনি ঢেলেই ওঁরা তৈরি করে ফেলছেন গুড়। তাতে জোগান বাড়ছে, দাম কমছে, কিন্তু খেজুর গুড়ের যে স্বাদ, গন্ধ, ঐতিহ্য- সবটাই নাকি আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
আসলে ঐতিহ্য ধরে রাখাটাও একটা বড় শিক্ষা। উত্তর কলকাতার রাস্তাগুলোয় হাঁটলে এখনও প্রতিদিন আফশোস করি, কবে এই বনেদি, ঐতিহ্যশালী বাড়িগুলোর সংরক্ষণ নিয়ে ভাবব আমরা। কয়েকদিন আগে বাগবাজারে কে সি দাশের ঐতিহ্যশালী রসগোল্লা ভবনের কথা বলেছিলাম আপনাদের। কুমারটুলি অঞ্চলের বাড়িগুলো দেখলে সত্যি মন খারাপ হয়। সে কুমারটুলি পার্কের ঠিক উল্টোদিকে ভাগ্যকুলের বায় পরিবারের বাড়ি কিংবা বিখ্যাত মদনমোহন মন্দির সবগুলো কীভাবে অবহেলায়, কালের নিয়মে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু অন্যরকম স্বাদ বদল হল বোরিয়া মজুমদারের বাড়ি। আত্মীয়তাসূত্রে এই বাড়িতেই এক সময় আনাগোনা ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের। বোরিয়াকে নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। ক্রিকেট গবেষক, কলামিস্ট, টিভি ধারাভাষ্যকার, বিশ্লেষক বোরিয়া কোনও সন্দেহ নেই এই শহরের মুকুটে অনেক নতুন পালক যোগ করেছেন। রাজারহাটের ইকো স্পেসে ওঁর তৈরি করা ‘ফ্যানটাস্টিক স্পোর্টস মিউজিয়াম’ গোটা পৃথিবীর ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের কাছে তীর্থস্থান হতে পারে। নিজের বাড়ির ক্ষেত্রে এই ঐতিহ্যটা বাঁচিয়ে রেখেছে। ইতিহাসের ছাত্র, তাই এই বাড়ির প্রতিটা ইট, কাঠের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ফেলে আসা সময়ের মূল্য বোঝেন বোরিয়া। ওঁর পূর্বপুরুষরা বিদ্যাসাগরের কাছে এই জমিটা পেয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর চিকিৎসার জন্য থেকে গেলেন ওঁদের বাড়িতেই। কারণ বোরিয়া হচ্ছেন প্রবাদপ্রতিম হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ প্রতাপ চন্দ্র মজুমদারের উত্তরপুরুষ। শুটিংয়ের কাজে সেদিন হাজির হতে হয়েছিল বোরিয়ার বাড়িতেই। দেওয়াল জুড়ে পুরোনো বাংলার সিনেমার পোস্টার। স্ত্রী শর্মিষ্ঠাও গবেষক। তাঁর গবেষণা আবার বাংলা সিনেমার একশো বছর নিয়ে। দেওয়াল জুড়ে বই। গত প্রায় দু’দশক এই দুষ্প্রাপ্য বই জোগাড় করে চলেছেন। বোরিয়া আর শর্মিষ্ঠা। শুটিং পর্বের পরে খাওয়ার ডাক পড়ল। লম্বা ডাইনিং রুম, সাদা কালো মার্বেলের মেঝে, মানানসই লম্বা একটা ডাইনিং টেবিল। টেবিলের পাশেই একটা পুরোনো ঘড়ির মতো ওভেন। টাইমার দেওয়া। সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের আশেপাশে তৈরি। ক্যান্টিন ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট। গুগলে দেখলাম, ১৯৫০ থেকে ক্যান্টিন ইন্ডিয়া রান্নাঘরের সরঞ্জাম তৈরি করছে। খাবার এল যথাসময়ে। ফিশ ফ্রাইয়ের সঙ্গে গলদা চিংড়ি, ইলিশ- ইতিহাস, ঐতিহ্যে মিশে যাচ্ছিল বাঙালির সাবেকি স্বাদ। কেন এপাড়ার ছেলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত ছোটবেলায় বিশ্ব পেটুক ছিলেন, খাবার মুখে তুললেই বুঝতে পারবেন। উত্তর কলকাতার রান্নায় সত্যিই জাদু আছে।
সিমলা থেকে আবার ফেরা যাক বহড়ুতে। সইদুলের সঙ্গে গল্প করতে করতে ভোর হয়ে এল। খেজুর রস নিয়ে ফিরছিলেন শিউলিরা। বহড়ু বাজারের সামনেই গুড় তৈরি করেন আহাট আর তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা। ভোরবেলায় রস নিয়ে ফিরলেন আহাট। আমাদের সামনেই মাটির উনুন ধরানো হল। হাঁড়িতে রস ঢেলে শুরু হল জ্বাল দেওয়া। বেশ কয়েকটা পর্বের পর রসের রঙ বদলাতে শুরু করেছিল। চেনা সোনালি তেলের রঙ আর গন্ধ। পুরো কাজটা সারছেন আনোয়ারা নিজে। তার মাঝেই গল্প করছেন। বলছেন, গুড় তৈরির গোটা প্রণালীটা। দিনের আলো পরিষ্কার হওয়ার আগেই তৈরি হয়ে গেল তাঁর গুড়। একটু খাবেন? অনুরোধ করলেন আহাটের মা। আটপৌরে শাড়ি, গ্রাম্য চেহারা, কিন্তু মুখটা মমত্বে মাখা। ওই অনুরোধ আর গরম গুড়ের লোভ ছাড়া গেল না। বাটিতে করে খেজুর গুড় দিলেন ওঁরা। আর দিলেন পাউরুটি।
সুকুমার রায় কেন লিখেছিলেন ‘ সবচেয়ে খেতে ভাল পাউরুটি আর ঝোলা গুড়’-সেদিন বুঝলাম। খুব ভালভাবে।
Editorial : বহড়ুর কথা
Read Time:9 Minute, 24 Second