Indo Curry : ইন্দো কারি ও রাসবিহারী বসু
ছোট্ট একটা লেখা হৃদয়ের কোন জায়গাটা ছুঁয়ে গেল বুঝতে পারছিলাম না ! ভালবাসা, দেশপ্রেম, স্বাদ নাকি স্বাধীনতা- একটা মহাজীবনে কত কিছু খুঁজবেন আপনি? সবটা পাবেন৷ একটা সর্বভারতীয় ওয়েবসাইটে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে নিয়ে একটা লেখা পড়ছিলাম৷ লর্ড হার্ডিঞ্জ হত্যার চেষ্টা বিফলে যাবার পর ব্রিটিশ পুলিশ তখন হন্যে হয়ে খুঁজছিল রাসবিহারী বসুকে ৷ আলিপুর বোমা মামলার পর দেরাদুনে ফরেস্ট রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে চাকরি নিয়ে চলে যান তিনি ৷ গোপনে যোগাযোগ রাখতেন বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে ৷ সেখান থেকেই হার্ডিঞ্জ হত্যার ছক ৷ পুলিশ যখন তাঁকে ধরতে মরিয়া, ফিরে আসেন ছোটবেলার শহর চন্দননগরে ৷ আত্মগোপন করেন সেখানেই৷ সেখান থেকেই ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে চলে যান জাপানে৷ জীবনের বাকিটা সময় কাটে সেখানেই৷ নিজের দেশ থেকে অনেকটা দূরে, একা একা স্বাধীনতার লড়াইয়ে ৷ জাপানে থেকেই ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে ৷ তৈরি করেছেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ৷ নিজের সংগঠনের দায়িত্ব সমর্পণ করেছেন সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে ৷
নেতাজির নেতৃত্বে আইএনএ এগিয়েছে ভারতের দিকে৷ স্বাধীনতার স্বপ্নে রাসবিহারী বসু থেকেছেন প্রতীক্ষায়৷ দেশের মুক্তি অবশ্য দেখে যেতে পারেননি৷ স্বাধীনতার দুই বছর আগে ১৯৪৫-এ জাপানেই মারা যান তিনি৷ কিন্তু রেখে যান উত্তরাধিকার৷ ভালবাসার, দেশপ্রেমের আর ভারতীয় খাবারের৷ অবাক হচ্ছেন তো? হ্যাঁ, এখনও জাপানের জনপ্রিয়তম খাবারের মধ্যে অন্যতম ইন্দো কারি, যার শুরু ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর হাতে৷ একটু বিস্তারিত ভাবেই বলা যাক৷ জাপানে পৌঁছে সেখানকার জনপ্রিয় নেতা মিৎসুরু তোয়ামার বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন রাসবিহারী বসু৷ ততক্ষণে ব্রিটিশ পুলিশ জেনে গেছিল, জাপানে আছেন তিনি৷ তাদের অনুরোধে জাপান পুলিশও মরিয়া হয়ে পড়ে তাঁকে ধরতে৷ কিন্তু রাজনৈতিক নেতা তোয়ামার বাড়িতে তল্লাশির স্পর্ধা ছিল না বলে বেঁচে যান ৷ পরবর্তীকালে রাসবিহারী বসু আশ্রয় পান নাকামুরায়ার সোমা পরিবারে৷ সোমা ফ্যামিলি একটা বেকারি চালাত ৷ সেখানে বেসমেন্টে আত্মগোপন করেছিলেন তিনি৷ সেসময়ই সেই পরিবারের বড় কন্যা তোশিকোর সঙ্গে মনের আদান-প্রদান হয়৷ ওই সময়টায় জাপানি সমাজে বিদেশিকে বিয়ের ভাবনাটা ছিল বেশ সাহসী ৷ এবং এমন একজনকে, যিনি পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ৷ তবু রাসবিহারী আর তোশিকোর প্রেমে সবকিছুর বাঁধ ভাঙে৷ আত্মগোপনের সময় ভারতীয় রান্নায় ইতিমধ্যেই সোমা পরিবারের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি ৷ তাই জাপানি ওই পরিবারের অনুমতি পেতেও অসুবিধা হয়নি ৷ অবশ্য ইতিমধ্যে পরিস্থিতিও কিছুটা বদলায় ৷ জাপানি নাবিকদের এক জাহাজে গুলি চালানোর ঘটনায় ব্রিটেন আর জাপানের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায় ৷ রাসবিহারী বসুর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তুলে নেয় জাপানি সরকার ৷ তবু স্বাধীনতার স্বপ্ন ভুলতে পারেননি তিনি ৷ জাপানি ও দেশবিদেশের নানা পত্রিকায় ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে লেখালেখি চলতে থাকে তাঁর ৷ যোগাযোগ শুরু করেন বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গেও ৷ পরিবারের দেখাশোনা করতেন তোশিকো ৷ কিন্তু সুর কাটল সেখানেও ৷ হঠাৎই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২৮ বছর বয়সে মারা যান তোশিকো ৷ বিদেশের মাটিতে একেবারে একা হয়ে যান রাসবিহারী বসু৷ এই সময়টাতেই শ্বশুর আইজোর সঙ্গে নাকামুয়ারা বেকারির ছাদে শুরু করেন এক রেস্তোরাঁ ৷ নতুন রেস্তোরাঁয় তাঁর রেসিপিতেই তৈরি হয় স্পেশাল চিকেন কারি, যার নাম হয় ইন্দো কারি ৷ কিছুদিনের মধ্যেই নাকামুয়ারার এই ইন্দো কারি শুধু টোকিওতে নয়, গোটা জাপানেই জনপ্রিয় হয়ে যায় ৷ নাকামুয়ারা বেকারির সিগনেচার আইটেম ছিল কাস্টার্ড বান ৷ ইন্দো কারি কিছুদিনের মধ্যেই তার চেয়েও অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে যায় ৷ প্রথম জাপানি রেস্তোরাঁ হিসেবে জাপানি স্টক এক্সচেঞ্জেও তাদের নাম নথিভুক্ত হয় ৷ এখনও জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড চেন তারাই ৷ প্রায় একশো বছর পরও বহু জাপানি খাদ্যপ্রেমী ভারতীয় চিকেন কারির স্বাদ পেতে হাজির হন সেখানে ৷ এই স্বাদে তো শুধু ভারতীয় মশলা নয়, মেশানো আছে ভালবাসা আর দেশপ্রেমের মিশ্রণও ৷ নাকামুয়ারার দেওয়ালে এখনও ঝোলানো রাসবিহারী বসুর ছবি, সোমা পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ৷ ১৯৪৫-এ যখন হাসপাতালে শেষ শয্যায়, তখনও নাকি নার্সদের বলেছিলেন, ‘আমার খিদে পাবে কী করে, তোমরা আমায় ইন্দো কারি খেতেই দিচ্ছো না ।’
‘দ্য বেটার ইন্ডিয়া’ নামের ওয়েবসাইটে লেখাটা পড়ে বোধহয় একটু আবেগপ্রবণই হয়ে পড়েছিলাম ৷ এক জীবনে কত কিছু ৷ আলিপুর বোমা মামলা, যুগান্তর থেকে নাকামুয়ারার ইন্দো কারি ৷ প্রতিবেদিকা সঞ্চারি পালকে অনেক অনেক অভিনন্দন এরকম একটা গবেষণাধর্মী লেখা আমাদের সবার সামনে তুলে ধরার জন্য ৷ এক বিস্মৃত বাঙালি বিপ্লবী এখনও কীভাবে জাপানিদের স্বাদকোরকে বেঁচে আছেন, সেই তথ্যটা হয়ত আমাদের অজানাই থেকে যেত৷