Potluck Competition পটলাক কম্পিটিশনঃ অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়
একটা ছোট কাগজের প্লেট৷ তার একপাশে এক চিমটে নুন আর এক ফালি লেবু৷ বাকিটা খালি৷ সেখানে লেখা, বাকিটা কালকে৷ আর এই ‘কালকে’-তেই, বালিগঞ্জ রেড এফএম-এর অফিসে হাজির আমরা৷ আমরা মানে অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ, সোনালি চৌধুরি আর ললিত গ্রেট ইস্টার্নের এগজিকিউটিভ শেফ মধুমিতা মোহান্ত৷ রেড এফএম কলকাতার স্টেশন হেড তৃণা চ্যাটার্জির ফোনটা এসেছিল কয়েকদিন আগে৷ অফিসে পটলাক পার্টি৷ খাবার টেস্ট করতে আর বিচারক হয়ে আসতে হবে আমাদের অফিসে৷ দুপুরেই হাজির আমরা৷ তখনও সবটাই ধোঁয়াশা৷ কী হতে চলেছে আর ঠিক কী করতে হবে আমাদের৷ তৃণা তার আগেই হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন৷ ‘মূলত আমাদের অফিসের নানা বিভাগের কর্মীরাই এতে অংশ নিচ্ছে৷ ৫টা টিম হয়েছে লটারি করে৷ তাদের মধ্যেই কম্পিটিশন৷ পটলাক ২০২০৷’ লিফট থেকে বেরিয়েই কম্পিটিশনের আঁচটা বোঝা গেল৷ রেড এফএম অফিসের চারপাশে পোস্টার, হ্যাংলার৷ রীতিমতো ‘ভোট ফর’ কায়দায়৷ আমার পাশ দিয়ে গেঞ্জি, ধুতি আর গলায় গামছা ঝুলিয়ে এক ভদ্রলোক হালকা হেসে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন৷ ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ নাকি৷ রহস্যভেদ করলেন তৃণাই৷ ‘সাতদিন ধরে অফিসে যা চলছে, সেটা জাস্ট ম্যাডনেস৷ আমাদের দিল্লি, মুম্বই অফিস খুব বড় করে পটলাক করেছে এবার৷ আমরাও ভাবলাম, তাই করি৷ কিন্তু যেটা হল, সেটা একেবারে ভাবনাচিন্তার বাইরে৷ সবাই প্রচণ্ড এক্সাইটেড৷ আইডিয়া, প্রমোশন এ-সব দেখলে রীতিমতো অবাক হয়ে যাবে৷’ তৃণার অফিস জুড়ে আপাতত সেগুলোই৷ কোনও টিমের উপহার পুজোর ডালা৷ জবা ফুলের মালা-সহ৷ কোনও টিম স্টেশন হেডের কার্টুন এঁকে রীতিমতো ফ্রেমবন্দি করে দিয়ে গেছে৷ আরও হাজারো উপহার৷ আর সোশ্যাল মিডিয়া খুললে তো আরও নানা চমক৷ বিভিন্নভাবে প্রমোশন চালিয়েছে পাঁচটা দল৷ কারও হয়ে প্রচারে নেমেছেন হিমেশ রেশমিয়া, তো কারও হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন বঙ্গীয় সেলেব কুল৷
মূলত পাঁচটা দল৷ প্রথম দল, ‘নো রিফিউজাল ফুড ক্যাব৷’ লোগোটা বেশ আকর্ষনীয়৷ হলুদ ট্যাক্সির গায়ে লেখা, নো রিফিউজাল৷ অর্থাৎ এই টিমের খাবার কিছুতেই ‘রিফিউজ’ করতে পারবেন না৷ আরজে প্রভীনকে দেখলাম, তার এই টিমের প্রচার নিয়ে রীতিমতো ব্যস্ত৷ একটা ভিডিও বানিয়েছেন৷ তাতে কলকাতার ট্যাক্সি ড্রাইভাররা বলেছেন, তাঁদের প্রিয় খাবার কোনটা৷ ‘নো রিফিউজাল ফুড ক্যাব’-এ সেগুলোই রাখতে চান প্রভীনরা৷ এরকম আরও ছিল৷ আরজে নীলমের টিম দেখলাম ‘ভোগনেশন টিভি’৷ তাদের প্রমোশনাল ভিডিওতে দেখলাম, চপ ভাজছে নীলম৷ মমতা ব্যানার্জির মিমিক্রি করে বলছেন, চপ ভাজুন৷ চপই শিল্প৷ সেখানে নরেন্দ্র মোদির মতো চাওয়ালাও আছেন৷ যিনি চা বানিয়ে বলছেন, ‘মিত্রোঁও’৷ রীতিমতো চেনা ডাক৷ চেনা সুর৷ ভোগনেশন টিভির মুখ্য ভূমিকায় তাঁরই৷ বাকি টিমরা হল মায়ের ভোগে, খানাগলি থেকে রাজপদ আর বাবা কা ধাবা৷ সবারই আলাদা আলাদা প্রমোশন, অফিস জুড়ে হইচই৷ ভিডিওতে অফিসের মধ্যে ছোট্ট মিছিলও দেখলাম৷ সেখানে ফেস্টুনে জ্বলজ্বল করছে লেখা, ‘খারাপ রাঁধুনির কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও৷’ হাজারো মজায় দুপুরটা ভালই কাটবে মনে হচ্ছিল, কিন্তু যেটা দেখলাম সেটা একেবারে ম্যাজিকাল৷ গোটা শহরের এনার্জি যেন জমা হয়েছে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির দেবালয় বিল্ডিংয়ের ছাদটায়৷ চিৎকার, চেঁচামেচি, ব্যান্টার- কী নেই৷ খাবারের গন্ধে ম ম করছে চারপাশটা৷ কোথাও গিটার বাজিয়ে গান হচ্ছে৷ গলা মিলিয়েছে কোনও অনাথ আশ্রম থেকে আসা এক ঝাঁক শিশু কিশোর৷
পটলাক পার্টির নিয়ম হল, গেস্ট-হোস্ট সবাই মিলে রান্না করে আনবেন একটা জায়গায়৷ সবার সমান পার্টিসিপেশন৷ আর সবাই মিলে খাওয়া৷ আমরা অবশ্য শুধুই গেস্ট নই, বিচারকও৷ তাই আমাদের কাজ শুধুই খাওয়া৷ গোটা দুপুরটা এই টেবিল, ওই টেবিল ঘুরে শুধু খেয়েই গেলাম৷ অরিত্র, পূজা, প্রভীনদের স্টল ট্যাক্সির কাট আউট দিয়ে তৈরি৷ গরম তাওয়ায় তৈরি হচ্ছে গরম পরোটা, লিট্টি৷ সঙ্গে আলুচোখা, কিমা কারি৷ আরও হাজারো আয়োজন৷ ট্যাক্সি ড্রাইভারদের ইউনিফর্মে ওদের টিমের সবাই৷ খানাগলি থেকে রাজপদ, ওদের টিমের খাবারের ভাবনা কলকাতার স্ট্রিট ফুড থেকে পার্ক স্ট্রিট- সবটা তুলে ধরা৷ ওখানে লোটে মাছ যেমন পেলাম, তেমনই পেলাম শাহি টুকরা৷ কলকাতার স্ট্রিট স্টাইলের চিলি চিকেন? তাও আছে৷ মায়ের ভোগে টিমের কনসেপ্ট হল, মায়ের ভোগ৷ কালো পোশাক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা হাদ্রে খড়্গ আর প্লাস্টিকের কাটা মুন্ডু নিয়ে আরজে মিথ, সুবর্ণা রীতিমতো তান্ত্রিক সেজে আছেন৷ মন্দিরের মতো সাজানো চারপাশটা৷ খাবার শুরুতেই যেটা এল, সেটা নাকি চরণামৃত শট৷ দুধ, ব্র্যান্ডি এ-সব মিশিয়ে নাকি তৈরি হয়েছে৷ কে জানে পৃথিবীর কোনও কাপালিক এর আগে কারণবারি নিয়ে এত ইনোভেটিভ হতে পেরেছিলেন কিনা৷ মায়ের ভোগে পেঁয়াজ, রসুন নিষিদ্ধ৷ ওদের মাটনের নাম তাই, মাটন নো পেঁয়াজা৷ বাবা কা ধাবায় আরজে অভিষেক বাবার ভূমিকায়৷ বাবা তো একটাই, সঞ্জুবাবা৷ আরজে নীলরা অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্বে৷ রীতিমতো ধাবা স্টাইলে৷ লস্যি আছে, পান আছে, ‘খাইকে পান বানারসি’ গানও আছে৷ পাশে তেলেভাজা তৈরির লাইভ কাউন্টার৷ খাবারেও তাই৷ মকাই কী রোটি, সর্ষো কা শাগ কিংবা সাদা ঘি- পুরোটাই পাঞ্জাবি স্টাইল৷ ট্রাকের ভাঙা লুকিং গ্লাসে মুখ দেখে নেওয়ার সুযোগ আছে৷ মাঝে মাঝে চিৎকারও চলছে, হরহর মহাদেব৷ উল্টোদিকে ভোগনেশন টিভি থেকে তখন চিৎকার আসছে, ক্যা ক্যা ছি ছি৷ চা আর চপের লড়াই৷ নীল পাড় সাদা শাড়িতে নীলম৷ রীতিমতো অগ্নিকন্যা৷
মনে রাখার মতো একটা দুপুর৷ অনেকটা এনার্জি নিয়ে ঘরে ফেরা৷ কে বলে, কর্পোরেট দুনিয়ার কিউবিকল গুলোয় শুধুই কেরিয়ারের উত্থান, পতন আর তৈলাক্ত বাঁশের হিসেব নিকেশ৷ একটা সফল সংস্থার সুস্থ কাজের পরিবেশে যে কয়েকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ থাকে, তাদের মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, স্ট্রং টিম স্পিরিট এবং কাজ আর জীবনের ব্যালান্স৷ রেড এফএম অফিসের ওই দুপুরটা সেটাই শেখাল৷ কাজের মাঝেও, কাজের বাইরেও টিম বিল্ডিং৷ একসঙ্গে লড়াই৷ খাওয়া, মজা, আড্ডা- কত কী! কাজ তো চলতেই থাকবে৷
সবশেষে আরও একটা কথা৷ পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, পরিচিত কেউ যদি কর্পোরেটে কাজের অজুহাত দিয়ে বলেন, রান্না জানি না৷ শেখা হয়নি৷ একদম বিশ্বাস করবেন না৷ কাজের বাইরে ওরা হলেন বেস্ট কুক৷ রেড এফএম পটলাক ২০২০-র বেস্ট ফুড হল, বেকড পায়েস৷ শেফ মধুমিতা থেকে বাকি সব বিচারক যেটা খেয়ে মুগ্ধ৷ মায়ের ভোগের টিমের সাক্ষী সরকারের আবিষ্কার৷ পায়েসকেও এভাবে বেক করা যায়৷ অসাধারণ খেতে হয়েছিল৷ সাক্ষীর রেসিপিকে আগামী দিনে হ্যাংলার পাতাতেও জায়গা দিতেই হবে৷ ওই দুপুরে এটা আমাদের আবিষ্কার৷