নাহুমনামা
হালকা হাওয়ার শীতের আমেজ আর নিউ মার্কেটের রঙিন দুনিয়া। এ শহরের শীতে এমন চেনা পরিচিত ছবি আর বোধহয় কিছুই হতে পারে না। ধরুন, আপনিও আছেন আমারই সঙ্গে। আর তাই চেনা কথাবার্তা…চলেছি পুরনো নিউ মার্কেটে। হগ মার্কেটের আপাত ম্যাড়ম্যাড়ে মাংসের বাজার কিংবা ফুলের বাজার পেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন উমম আর কোথাও নয় শতাব্দী প্রাচীন নাহুম অ্যান্ড সন্স-এ। ১১৩ বছরের পরম্পরা আর ঐতিহ্যের মোড়কে আজও থমকে আছে এই শহরে। থমকেই বা কেন বলব, একেবারে মিলেমিশে একাকার। তা না হলে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে আমি বা আপনি আসবই বা কেন এহেন নাহুম অ্যান্ড সন্স-এ।
ঠিক যেন পৌঁছে গিয়েছি ষাট অথবা সত্তরের দশকের কালো বার্নিশের ছিমছাম শোকেস, টেবিল পেরিয়ে সেই চেয়ারের দিকে। যেখানে বসে আছেন ইজরায়েল নাহুম। তিনি আর নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে বাকি সবই। সেই টেবিল, শোকেস আর তার মধ্যে রিচ ফ্রুট কেক, ব্রাউনি, ম্যাকারুন, বাকলাভা, জ্যাম টার্ট, চিজ সমোসা, আরও কত কী!
ইজরায়েল থেকে কলকাতায় এসে পড়লেন ইজরায়েল নাহুম। এটা সেটা কী করবেন ভাবতে ভাবতেই বাড়িতে যেমন করে বানানো হয় তেমন করেই ইহুদি খাবার ব্যান্ডান বানানো থেকে ব্যবসা শুরু করলেন তিনি। সময়টা ১৮৭৪। এরপর কিছু বছর পেরিয়ে এস এস হগ মার্কেটের সামনের দিকে (এখন যেখানে ফ্লাওয়ার স্ট্রেচ) সেখানে জায়গা পেলেন নাহুম। একদম সাদা-কালো ঝাপসা ছবি। হবে নাই বা কেন? সময়টা যে ১৯০২। এবার কিছুটা রঙ মাখতে মাখতে হগ মার্কেটও নতুন রূপ পেল আর ১৯১৬-তে নাহুম পেলেন F-20, New Market ঠিকানা। যা এখন কলকাতাবাসী থেকে শুরু করে দেশ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষের অত্যন্ত আগ্রহের ঠিকানা হয়ে উঠেছে।
ইজরায়েল নাহুমের পর এই ব্যবসার রাশ ধরেন তিন পুত্র। নর্ম্যান, সলোমন এবং ডেভিড। এখন তাও অতীত। রয়ে গিয়েছেন শুধুই ডেভিড ইলায়েজ। ৮৫ বছরের অশক্ত ডেভিড এখন আর রোজ আসতে পারেন না তাই খ্যাতির ব্যাটন হাতে তুলে দিয়েছেন দীর্ঘ ৩৪ বছরের বিশ্বস্ত কর্মী জগদীশচন্দ্র হালদারকে।
রিচ ফ্রুট কেক থেকে শুরু করে মার্জিপ্যান, নাহুমের প্রায় ৯০ রকম আইটেমের প্রত্যেকটি তৈরি হয় নাহুম পরিবারের শতাব্দী প্রাচীন এক্সক্লুসিভ রেসিপি দিয়ে। অ্যান্টিক শোকেসে রাখা প্রত্যেকটি খাবারের স্বাদ বারবার টেনে আনে আমাদেরকে। চোখ পড়ল ধুকেই মাঝখানের শোকেসের ওপরে রাখা ব্রাউনিতে। জানলাম ১৯৮২-তে নাহুমে শুরু হয় ব্রাউনি তৈরি। এর রেসিপিও নাহুম পরিবারের। জগদীশবাবুর মতে, শুধু রেসিপিই নয়, প্রথম থেকে এখনও পর্যন্ত খাবার তৈরির কাঁচামালেও হেরফের হয়নি একটুও। ১৯০২-এ বাটার এদেশে তৈরিই হত না তাই বাটার বাইরে থেকে আনাতেন ইজরায়েল নাহুম। তবে এখন ব্যবহার হয় দেশি বাটারই। ব্যবসার শুরুতে কোয়ান্টিটি নয় কোয়ালিটিকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন নাহুম। তাই পরিমাণ বাড়াতে অন্য সব কনফেকশনারি বাটারের বদলে মার্জারিন ব্যবহার করলেও নাহুম অ্যান্ড সন্স এ ব্যাপারে আপস করতে নারাজ।
দোকানের বিভিন্ন দিকে চোখ বুলিয়ে মনে হল এখানকার আসবাবপত্রের মতোই প্রাচীনপন্থী এখানকার কর্মীরাও। নাহুমের একমাত্র মহিলা কর্মী ৭৯ বছরের জেসিকা ব্যপটিস্ট। ৩০ বছর ধরে কাজ করলেও এখনও সব স্মৃতি উজ্জ্বল তাঁর। ক্যাশ ডেস্কের ছবি তুলতে বললেন জেসিকা। এর সঙ্গে জড়িত গল্প শুনলাম। মনে হল ওই ক্যাশ ডেস্কেই ইজরায়েল নাহুম যেন বসে দোকানে আসা ক্রেতাদের উৎসুক চোখ দেখে পরামর্শ দিচ্ছেন মার্জিপ্যান খাওয়া যাবে না জ্যাম টার্ট। শুরুতে চকোলেট, মার্জিপ্যান আর ফাজ পাওয়া গেলেও সেই সাদা-কালো ছবি বদলাতে বদলাতে এখন প্যাটিস থেকে পেস্ট্রি সবই পাওয়া যায়। আর ক্রিসমাসে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের অনন্ত অপেক্ষা থাকে রিচ ফ্রুট কেকের জন্য। এ ছাড়াও চাহিদা থাকে ব্রাউনি আর ম্যাকারুনস-এর। ক্রিসমাসে তাই চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে কাজের সময়ের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। এক লট রিচ ফ্রুট কেক বানাতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা।
১১৩ বছর সময়টা মোটেও কম নয়, তাই গল্পের শেষ নেই। জেসিকার সঙ্গে গল্প শুনতে শুনতে ১৯০২-এ পৌঁছে গেছিলাম। আর যায় নাই বা কেন? এখনও একইরকম ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সব কিছু। হঠাৎ মোহভঙ্গ। দোকানে এসে হাজির এক তরুণী, নাম নেহা সিং। বেঙ্গালুরুবাসী তাঁর বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন নাহুমে। কিন্তু সেদিনের মতো শেষ হয়ে গিয়েছিল রিচ ফ্রুট কেক বা প্লাম কেক। হ্যাঁ, এমন করেই প্রতিদিনের প্রোডাকশনের ৯০% খাবার ফুরিয়ে যায়। যেটুকু পড়ে থাকে সেটুকু পাঠানো হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এই সব ছোট ছোট গল্প বলতে বলতে স্মৃতি উজ্জ্বল হয় জেসিকার। নস্টালজিয়া পেরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াই এ শহরে প্রায় অবলুপ্ত হাতে গোনা ইহুদি পরিবারের সদস্যদের পাশে, একই সঙ্গে ইজরায়েল থেকে আসা ইহুদি যুবক ইভানের পাশেও। আমার পাশে দাঁড়িয়ে তখন হতাশ ইভান। কারণ শুধু নাহুমের কেক নয়, ইভান এসেছিলেন এখনও বেঁচে থাকা ইহুদি পরিবারগুলোর ১৩ জন সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করতে। কিন্তু হল না। নাহুম পরিবারের সদস্য সংখ্যা কলকাতাতে যেমন কমেছে তেমন একইভাবে কমেছে ইহুদিদের সংখ্যাও। ১১৩ বছর আগে ইজরায়রল নাহুম যখন ব্যবসা শুরু করেছিলেন তখনও মনে হয় তিনি ভাবতে পারেননি এক ইহুদির হাতে তৈরি কেক কলকাতার ক্রিসমাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়বে। তাই কলকাতায় এখন ইহুদি সংখ্যা মাত্র ২০ জন হলেও এই নাহুমের কেকই মোজেস ভক্তদের সঙ্গে অথবা যিশুভক্ত অথবা তাবড় কলকাতা কেকপ্রেমীদের মিলিয়ে দেয় একই স্বাদের টানে। আর সেই টানই হল ২০১৫-র ঝা-চকচকে রাস্তাঘাট, ফাইন ডাইনিং থেকে অ্যান্টিক শোকেসে রাখা রিচ ফ্রুট কেক অথবা ব্রাউনি।
~সায়ন্তনী দত্ত